ঘন ঘন স্বল্পমাত্রার ভূমিকম্পকে বৃহৎ ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বিবেচনা করিলে ইহা স্পষ্ট, বাংলাদেশকে বৃহৎ ভূমিকম্পের সতর্কতা প্রদান করিয়া যাইতেছে প্রকৃতি। গতকাল টাঙ্গাইলে উৎপন্ন ৪ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্পটির পূর্বে ৯ সেপ্টেম্বর সিলেট অঞ্চলে ঘটিয়াছিল ৪ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প। আমরা উদ্বেগের সহিত দেখিতেছি, আগস্ট হইতে পূর্ববর্তী চার মাসে আরও চারটি মধ্যম মাত্রার ভূমিকম্প ঘটিয়াছিল, যেইগুলির উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের সীমারেখার অভ্যন্তরে। আর এই বৎসরই তিনটি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকা ও সংলগ্ন অঞ্চলে শনাক্ত হইল: এই দফায় টাঙ্গাইল, ঢাকার দোহার এবং এপ্রিল মাসে নারায়ণগঞ্জে। বস্তুত ইহা লইয়া গত এক যুগে রাজধানী-সংলগ্ন অঞ্চলে ৯টি ভূমিকম্প উৎপন্ন হইল। এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা সকলকে পুনর্বার স্মরণ করাইয়া দিতে চাহি, এখনও অলস বসিয়া থাকা হইবে আত্মঘাতের নামান্তর।

আমরা জানি, ভূমিকম্প প্রতিরোধ সম্ভব নহে। কিন্তু হইার প্রতিষেধক হইতেছে ভূমিকম্প-সহনীয় ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ। বিশ্বব্যাপীই দেখা গিয়াছে, যেই সকল দেশে ভবন নির্মাণে সতকর্তা অবলম্বন করা হইয়াছে, তথায় ভূমিকম্পের ক্ষতি অপেক্ষাকৃত স্বল্প। এই ক্ষেত্রে আমেরিকা মহাদেশের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র চিলি ও হাইতির ভূমিকম্প ‘পাঠ্যপুস্তক উদাহরণ’ হইয়া রহিয়াছে। ২০১০ সালে চিলিতে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৭০০ প্রাণহানি ঘটিয়াছিল। হাইতিতে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ২ লক্ষ ২০ সহস্র নাগরিক প্রাণ হারাইয়াছিল। ধ্বংসযজ্ঞের এই তারতম্যের কারণ ভবন নির্মাণে দেশ দুইটির দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য। চিলি যথায় ‘বিল্ডিং কোড’ অক্ষরে অক্ষরে মানিয়া চলে, হাইতি তথায় ভূমিকম্পের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করিবার পূর্ব পর্যন্ত এই বিষয়ে মনোযোগী ছিল না।

আমাদের দেশেও ২০০৮ সালে জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণীত এবং ২০২০ সালে হালনাগাদ হইয়াছে। কিন্তু মানিতেছে কিংবা মানানো হইতেছে কতখানি, উহাই প্রশ্ন। এইদিকে খোদ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের পক্ষে ২০১৮ হইতে ২০২২ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গিয়াছে, মধুপুর চ্যুতিতে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হইলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসিয়া পড়িবে।

ভূমিকম্পটি দিবালোকে আঘাত হানিলে শুধু ঢাকা নগরীতেই ২ লক্ষ ১০ সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারাইবে। আর রাত্রিকালে আঘাত হানিলে কী ঘটিতে পারে, উহা আমরা উচ্চারণ করিতে চাহি না। কিন্তু এই প্রশ্নটি করিতেই হইবে, আমরা কি চিলি, না হাইতির পথ বাছিয়া লইতে চাহিতেছি?