লিবিয়াকে মানুষ সাধারণত মরুভূমির দেশ হিসেবেই চেনে। এখানে কিছু এলাকায় ৩০ বছরেও কোনো বৃষ্টিপাত হয় না। উপকূলীয় যেসব শহরে বৃষ্টিপাত হয়, সেখানেও বর্ষাকালে মাসে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাত্র ৪০ মিলিমিটার। অথচ সেই লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় ডেরনা শহরে গত ১১ সেপ্টেম্বর এক দিনেই ১০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।
ড্যানিয়েল নামক প্রচণ্ড ঝড় এবং বৃষ্টিপাতের প্রভাবে শহর রক্ষাকারী দুটি বাঁধ পরপর ভেঙে পড়েছে। এর ফলে সৃষ্ট প্রবল বন্যায় শহরের প্রায় এক-চতুর্থাংশ এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। সেখানকার বাড়িঘর এবং রাস্তাঘাট মাটি ধসে সমুদ্রে তলিয়ে গেছে।

ডেরনা শহরটি বেশ ছোট। সেখানে মোট ৯০ হাজারের মতো মানুষ বসবাস করত। এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যে সরকারি হিসাবে মারা গেছে প্রায় ৬ হাজার মানুষ। নিখোঁজ রয়েছে প্রায় ১১ হাজার। আশঙ্কা করা হচ্ছে, শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ হয়তো এ বন্যায় নিহত হয়েছে।

ডেরনা শহরে ৭০ থেকে ৮০ জনের মতো বাংলাদেশিরও বসবাস ছিল। এখন পর্যন্ত পাওয়া সংবাদ অনুযায়ী তাদের মধ্যে ছয়জন নিহত হয়েছেন। বাকি বেশ কয়েকজন এখনও নিখোঁজ। আশঙ্কা করা হচ্ছে, নিহত বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়তে পারে।

নিহতদের মধ্যে চারজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের দু’জন নারায়ণগঞ্জের, দু’জন রাজবাড়ীর। বাকি দু’জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। নিহতদের সেখানেই দাফন করা হয়েছে।

ডেরনা শহরে যেসব বাংলাদেশি ছিলেন, তাদের অধিকাংশই সেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে অথবা বিভিন্ন দোকানে সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। তাদের একটি বড় অংশই সেখানে গিয়েছিলেন গত কয়েক বছরের মধ্যে। নিহতদের মধ্যে দু’জন সেখানে গিয়েছিলেন চার থেকে আট মাস আগে। বাকি দু’জন গিয়েছিলেন চার বছর আগে।

নিহত একজন নারায়ণগঞ্জের মামুন অমিতের ফেসবুক আইডিতে দেখা গেছে, মৃত্যুর এক দিন আগে, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখে তিনি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, সেদিনই তাঁর প্রবাসে আসার চার বছর পূর্ণ হয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, ‘আজও বলতে পারি না, কবে বাড়িতে যাবো। বাড়িতে যাওয়াটা এখন স্বপ্নের মতো।’
মামুনের সে স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। এর কয়েক ঘণ্টা পর ১১ সেপ্টেম্বর রাত দেড়টায় তিনি স্থানীয় একটি পেজ থেকে পোস্ট করা বন্যার প্রবল স্রোতের একটি ভিডিও শেয়ার করে ক্যাপশন দেন, ‘আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুক, আমিন।’ এর মাত্র দেড় ঘণ্টা পরই বাঁধ ভেঙে পড়ে।
লিবিয়ায় এমনিতে প্রায় কোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে না। বছরের অধিকাংশ সময় বৃষ্টিপাতও হয় না। ডেরনা শহরে বাঁধের পানি যাওয়ার জন্য যে ফ্লাড কন্ট্রোল চ্যানেল ছিল, বছরের অধিকাংশ সময় সেটিও শুষ্ক থাকত। আগে ডেরনায় ছিলেন, এমন এক বাংলাদেশির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুষ্ক সেই খালে বাংলাদেশি অনেকেই মাঝেমধ্যে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলতেন। তারা কেউ ভাবতেও পারেননি, কোনো একদিন এই খাল দিয়ে যাওয়া বন্যার
পানিই উপচে পড়ে আশপাশের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

ড্যানিয়েল ঝড় যে ছুটে আসছে– এই পূর্বাভাস ছিল। সরকার তিন দিনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল; সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে ছুটি দিয়েছিল; মানুষকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছিল। ঝুঁকিপূর্ণ কিছু এলাকা থেকে মানুষকে সরে যাওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু লিবিয়ায় মানুষের এ রকম দুর্যোগ দেখার অভিজ্ঞতা নেই; তাই অনেকেই এ পূর্বাভাসকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি।
আশঙ্কা ছিল, কিছু ক্ষয়ক্ষতি হবে; কিছু এলাকায় ফ্ল্যাশ ফ্লাড হবে। হয়তো কিছু মানুষ মারাও যাবে। কিন্তু সংখ্যাটা যে এ রকম অকল্পনীয় হবে, এটি কেউ কল্পনাও করেনি। এতটা ক্ষতি হয়তো হতোও না, যদি বাঁধ দুটি ভেঙে না পড়ত।

বাঁধ কেন ভেঙে পড়েছে, তা হয়তো তদন্তের পর বলা যাবে। ১৯৭০ সালে নির্মিত বাঁধ ঝড়ের কথা মাথায় রেখে ডিজাইন করা হয়েছিল কিনা, সেটি একটি বিবেচ্য বিষয় হতে পারে। কিন্তু আপাতত যা জানা গেছে, বাঁধ দুটি সবশেষ মেরামত করা হয়েছিল ২০০২ সালে; ২১ বছর আগে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় লিবিয়ানদের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে অধিবাসী অনেকেই বাঁধের দুরবস্থার কথা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল, কিন্তু কেউ তাদের কথায় কর্ণপাত করেনি।

এর আগে লেবাননের বৈরুত পোর্টে বিস্ফোরণ এবং তুরস্কের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে আমরা যে রকম দেখেছিলাম, দুর্যোগ অনভিপ্রেত হলেও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক সময়ই বেশি হয় দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলাজনিত কারণে। ডেরনার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গাদ্দাফির সময়েও লিবিয়া অবকাঠামোগত দিক থেকে পিছিয়ে ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে গাদ্দাফির পতনের পর চলমান গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক বিভাজন এবং দুই সরকারের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয়হীনতা পুরো ব্যাপারটি আরও জটিল করে তুলেছে। এসব কিছুর সম্মিলিত ফলাফলই হলো ডেরনার এই ভয়াবহ বিপর্যয়।
ডেরনার ঘটনার পর সেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লিবিয়ার দুই সরকার পাশাপাশি কাজ করছে। কিন্তু তাদের এই মনোভাব যদি দীর্ঘস্থায়ী না হয়, যদি লিবিয়ার রাজনৈতিক সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যে আরও ঘটবে না– তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা: লিবিয়া
প্রবাসী প্রকৌশলী ও লেখক