- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- পণ্যের মোড়কে ভেলকি দিয়ে প্রতারণা
ভোক্তা অধিকার
পণ্যের মোড়কে ভেলকি দিয়ে প্রতারণা

বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের মূল্য কমে যাওয়ার পরও দেশের বাজারে এর কোনো সুফল নেই কেন– সে প্রশ্ন দেশের কোটি ভোক্তার। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো পণ্যের মূল্য প্রথমে অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়। এর পর সরকারের চাপে সামান্য কমানো হয়। তাতে ভোক্তার জীবনে কোনো স্বস্তি আসে না। আপনি খুচরা বিক্রেতা থেকে শুরু করে মজুতদার, যে কারও সঙ্গে এ নিয়ে কথা বললেই তাদের মুখস্থ উত্তর– আমদানি ব্যয় বেশি, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বেশি। এ রকম উত্তর শুনে আপনার আর দ্বিতীয়বার কথা বলার ইচ্ছা থাকবে না। যদি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমেছে; তাহলে শুনবেন, এখনও সে পণ্য আসেনি। অথচ মূল্য বৃদ্ধির সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়াতে তাদের আমদানি করার প্রয়োজন হয় না।
ভোক্তার অধিকারের বিষয়টি বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে আইনগত অধিকার। সে অধিকার রক্ষায় আইনের পাশাপাশি অনেক রকম ব্যবস্থা বিদ্যমান। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালিত হয় এবং আমরা দেখি কীভাবে উৎপাদক বা বিক্রেতারা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। অনেক সময় দেখা যায়, মালিকপক্ষ ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসহযোগিতা করে। কেউ কেউ নিজেদের দাপট দেখানোরও চেষ্টা করে। এর পরও বলব, এ জাতীয় অভিযান জনমনে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। কিন্তু বাজারের হাল যেভাবে বেহাল হচ্ছে, তাতে বিচ্ছিন্ন অভিযানে সুফল কতটা আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
করোনা-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি অজুহাতে আমাদের ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি করেছে, যা আজও অব্যাহত। মোড়কজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে ভোক্তা পণ্যের গায়ে লেখা মূল্য দেখেই তা বুঝতে পারে। যদি এমন হয়, মূল্য ঠিক রেখে বা সামান্য বৃদ্ধি করে পণ্যের গুণ, মান ও পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা বুঝতে পারা অনেক কঠিন। কিন্তু মূল্য বৃদ্ধির এ সময়ে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ভিন্নতা। কেননা, সেসব পণ্যের মূল্য বাড়ানো হয়নি কিংবা খুব সামান্য বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা ভোক্তাদের কাছে সহনশীল। কৌশলটা এখানেই হচ্ছে, দাম প্রায় অপরিবর্তিত রেখে পণ্যের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে ভোক্তার পক্ষে সেটা বুঝতে পারা বেশ কঠিন। এ রকম কিছু পণ্যের বিষয়টি নিজেই খেয়াল করেছি এবং সে বিষয়গুলো পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতেই এ লেখা।
বোতলজাত ও মোড়কজাত দু’ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রে এমনটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একটা কোমল পানীয়, যার লিটার আগে ছিল ৬০ টাকা; এখন ১.২৫ লিটারের মূল্য ধরা হয়েছে ১০০ টাকা। কোম্পানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছে অত্যন্ত কৌশলে। পরিমাণে সামান্য বাড়িয়ে দাম নেওয়া হচ্ছে অনেক বেশি। আবার একটি শ্যাম্পু কিনতে গিয়ে দেখলাম, বোতলের ওপরের অংশ অনেকটা খালি। ভালো করে পড়ে বুঝলাম, এখন আগের চেয়ে পরিমাণে কম দেওয়া হচ্ছে, যা বোতলের গায়ে ছোট করে লেখা, কিন্তু বোতলটি আগের আকারেই আছে। সে শ্যাম্পুটির দামও বাড়ানো হয়েছে, আবার পরিমাণেও কম দেওয়া হচ্ছে। তেমনিভাবে সাবানের আকার ছোট করা হয়েছে, কিন্তু প্যাকেট সেই আগেরটাই আছে।
আবার একটি বিস্কুটে দেখলাম, আগে যেখানে ৬ পিস থাকত, এখন সেখানে থাকে ৪ পিস; দাম ঠিকই আছে। এর মানে, ভোক্তা হিসেবে আমরা শুধু মূল্যটাই দেখছি; ভেতরের ফাঁকিটা বুঝতেই পারছি না। তেমনি অন্য একটি বিস্কুটের প্যাকেট বাসায় আনার পর দেখলাম, আগের চেয়ে কম অথচ প্যাকেট একই আকারের। শুধু তাই নয়; প্যাকেটের ভেতর যে প্লাস্টিকের বক্স ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা এমনভাবে তৈরি, যাতে বাইরে থেকে বোঝা না যায়। আবার কোনো কোনো বিস্কুটের প্যাকেটের একাংশ কেবল টুকরো কাগজ দিয়ে ভর্তি করা থাকে সেটাকে বড় করে দেখানোর জন্য।
উৎপাদক প্রতিষ্ঠান হয়তো বলতে পারে, পণ্যের গায়ে পরিমাণ উল্লেখ করেই বাজারজাত করা হয়েছে; তারা কোনো কারসাজি করছে না। তাদের বক্তব্য সঠিক, কিন্তু সেখানে আরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। পরিমাণে কম দেওয়ার পরও কেন মোড়ক বা বোতলের আকার আগের মতোই আছে?
তাই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। আমাদের মনে রাখা দরকার, দেশের ভোক্তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ উৎপাদকদের এত কৌশল বোঝার অবস্থায় নেই। যারা বুঝতে পারেন তাদেরও তেমন কিছু করার নেই। আমাদের কোনো না কোনো পণ্য কিনতেই হবে, পরিমাণে কম হলেও। সে জন্য মোড়ক বা বিজ্ঞাপনে পণ্যের পরিমাণ কমলে তা দৃশ্যমান আকারে প্রচার করার নিয়ম বাধ্যতামূলক করা উচিত বলে মনে করি। একই সঙ্গে পরিমাণ কমলে মোড়কের আকার ছোট করার বিষয়ও বিবেচনায় নিতে হবে, যাতে সহজ-সরল ক্রেতা তা দেখেই বুঝতে পারে। কোম্পানিগুলো যখন কোনো পণ্যের দাম কমায় বা সঙ্গে কোনো উপহার দেয় তখন কিন্তু সব মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে বারবার জানান দেয়। অথচ যখন পরিমাণে কম দেওয়া হচ্ছে, তখন কোনো প্রচার নেই, যা কাম্য নয়।
আবুল কাশেম উজ্জ্বল: শিক্ষক, সমাজকর্ম
বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট
মন্তব্য করুন