কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সোমবার ঘোষণা করেন, জুনে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া রাজ্যের অধিবাসী শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী এক নেতাকে হত্যায় ভারতীয় সরকারের এজেন্টদের জড়িত থাকার ‘বিশ্বাসযোগ্য’ প্রমাণ রয়েছে। ট্রুডোর এ ঘোষণায় দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি ঘটে। অন্যদিকে ভারত ইতোমধ্যে কানাডার বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছে, স্বাধীন শিখ ভূখণ্ডের দাবিতে কানাডায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ট্রুডো জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। মঙ্গলবার ভারতীয় সরকারের এক মুখপাত্র ট্রুডোর ওই অভিযোগ ‘হাস্যকর এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ‘কানাডার প্রধানমন্ত্রী একই অভিযোগ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে করেছিলেন, যেটি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।’

কানাডা কর্তৃপক্ষ আরও বলছে, তারা একজন ‘গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় কূটনীতিককে’ বহিষ্কার করেছে। এই কূটনীতিক কানাডায় ভারতীয় বিদেশি গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান।

চলতি বছরের ১৮ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া রাজ্যের সারেতে এক শিখ মন্দিরের বাইরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন হারদ্বীপ সিং নিজ্জার। নিজ্জার শিখদের স্বাধীন ভূমি তথা খালিস্তানের জন্য প্রচারণা চালান। তারা ভারতের পাঞ্জাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র দাবি করছে। ভারতীয় সরকার ২০২০ সালের জুলাই মাসে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাঁকে তারা ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যা দেয়।

কানাডার গোয়েন্দা সংস্থা অবশ্য আগেই নিজ্জারকে সতর্ক করেছিল, তাঁর জীবনের ওপর হুমকি রয়েছে। ওয়ার্ল্ড শিখ অর্গানাইজেশন অব কানাডার মতে, ‘তিনি আততায়ীর পরিকল্পিত গুলিতে নিহত হন।’
ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৫৮ শতাংশ শিখ এবং ৩৯ শতাংশ হিন্দু। এ রাজ্যে আশি এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুতে খালিস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হয়। এতে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। প্রাণ হারায় হাজারো মানুষ। বর্তমানে বিদেশে বসবাসরত পাঞ্জাবি শিখরা সেই আন্দোলনের সবচেয়ে সোচ্চার অংশ। 

প্রশ্ন হলো, ভারত কেন কানাডার শিখ কমিউনিটিকে লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে? কানাডায় বসবাসরত বিদেশিদের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ সংখ্যায় অন্যতম শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। কানাডার চার কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ভারতীয় রয়েছে প্রায় ১৪ লাখ। ২০২১ সালের জনসংখ্যা জরিপ অনুসারে, এর মধ্যে ধর্মীয় অনুসারীর দিক থেকে শিখ ধর্মাবলম্বী প্রায় ৭ লাখ ৭০ হাজার। নিজস্ব রাজ্য ভারতের পাঞ্জাবের বাইরে কানাডায় সবচেয়ে বেশি শিখের বসবাস।

ভারত প্রায়ই প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে শিখ কট্টরপন্থিদের কার্যকলাপের ব্যাপারে কানাডা সরকারের কাছে অভিযোগ করে। তারা বলছে, শিখরা বিদ্রোহ চাঙ্গা করতে সচেষ্ট। জুন মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ জন্য কানাডার ব্যাপক সমালোচনা করেন। কারণ কানাডা এমন একটি মিছিলের অনুমতি দেয়, যেখানে ১৯৮৪ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যে তাঁরই দেহরক্ষী দ্বারা নিহত হয়েছিলেন– সে ঘটনা অভিনয় করে দেখানো হয়। এই সহিংসতার ঘটনাকে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের গৌরব হিসেবে প্রচার করে। 

২০১৮ সালে জাস্টিন ট্রুডো ভারতে এ নিশ্চয়তা দেন– কানাডা এমন কাউকে সমর্থন করবে না, যে ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। তবে ট্রুডো বারবার এটি বলেছেন, তিনি স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকারকে সম্মান করেন। প্রতিবাদ কর্মসূচিতে জড়ো হওয়াকে তিনি সেভাবেই দেখেন।
এ অবস্থায় কানাডা-ভারত সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি দেখা যাক। এই বছরের শুরুতে উভয় দেশ ঘোষণা করে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ তারা একটি বাণিজ্য চুক্তির রূপরেখায় একমত হতে যাচ্ছে। কিন্তু সেই চুক্তির আলোচনা এখন হিমাগারে চলে গেছে। কানাডা এর কারণ বিস্তারিত বর্ণনা করেছে, তবে ভারত তাকে বলছে ‘সন্দেহাতীতভাবে রাজনৈতিক বিষয়’।

ভারত হলো কানাডার দশম বাণিজ্যিক অংশীদার। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তারা একটি বাণিজ্যিক চুক্তি করার পরিকল্পনা করছে। কানাডার পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, যেখানে কানাডার পুরো বাণিজ্যের পরিমাণ ১ দশমিক ৫২ ট্রিলিয়ন ডলার।

মঙ্গলবার হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ ভারত শুধু অস্বীকারই করেনি; এ প্রসঙ্গে দেওয়া বিবৃতিতে ভারত সরকার ট্রুডোর কাছে এ আবেদন আবার জানায়, তিনি যেন তাদের ভাষায়, যারা কানাডার ভেতর থেকে ‘ভারতবিরোধী তৎপরতা’ চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শুধু তাই নয়; এর পর ভারত কানাডার একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। তার আগে সোমবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী হাউস অব কমন্সে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ তদন্ত করছে– এ হত্যার পেছনে ছিল দিল্লি; এটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যা। ট্রুডোর ভাষায়, ‘কানাডার মাটিতে একজন কানাডিয়ানকে হত্যায় বিদেশি সরকারের কোনো ধরনের জড়িত থাকার বিষয়টি আমাদের সার্বভৌমত্বের অগ্রহণযোগ্য লঙ্ঘন।’ তাঁর ভাষায়, ‘কানাডা আইনের শাসন মেনে চলে। আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে আমাদের নাগরিকের সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত মৌলিক একটা বিষয়। আমাদের অগ্রাধিকারের প্রথমটি হলো, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সব কানাডিয়ানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। দ্বিতীয়টি হলো, এই হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

দিল্লি এর আগে অভিযোগ করেছিল, নিজ্জার পাঞ্জাবে এক হিন্দু পুরোহিতকে হত্যার পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল। সে জন্য ১২ হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। যে কারণে নিজ্জারকে গুলি করে হত্যায় অনেকেই ভারতকে দায়ী করছেন।
শিখ হত্যার ব্যাপারে জাস্টিন ট্রুডোর বক্তব্য এমন সময়ে এলো, যার এক সপ্তাহ আগে তিনি জি২০ সম্মেলনে অংশ নিতে দিল্লি সফর করে গেছেন। সেখানে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘটিত নানা ঘটনায় এ উত্তেজনার ইঙ্গিত মেলে। এক বৈঠকের পর নরেন্দ্র মোদির অফিস জানায়, ভারতীয় নেতা কানাডায় ভারতবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনাকারীদের দ্বারা চরমপন্থি উপকরণ ব্যবহার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

সর্বশেষ পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে। দুই দেশের এ উত্তেজনা কোথায় গড়ায় সেটাই দেখার বিষয়।

গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ ভাষান্তর
মাহফুজুর রহমান মানিক



বিষয় : কানাডার সঙ্গে ভারতের বাড়তে থাকা উত্তেজনার নেপথ্যে দ্য গার্ডিয়ান শিখ হত্যা

মন্তব্য করুন