রাজনীতি
নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

হাসান মামুন
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি ক্ষমতাসীনরা কোনোভাবেই মানবে না। অতীতে বিএনপি সরকারও এটা মানতে চায়নি। না মেনে একতরফা নির্বাচনও করে ফেলেছিল। অবশ্য বলা হয়ে থাকে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতেই ওই নির্বাচন সেরে জাতীয় সংসদ গঠনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মনে হয় না, ব্যাপারটা এত সরলরৈখিক। বিতর্কিত ওই নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যেতে পারলে তারা হয়তো তখন অন্য সুরে কথা বলত। জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলকে পাশে নিয়ে আওয়ামী লীগ তখন একটা কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিল। জনপ্রশাসনের ভেতর থেকে গড়ে উঠেছিল ‘জনতার মঞ্চ’। একটি রাজনৈতিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ভেতর থেকে এমন বিদ্রোহমূলক ঘটনা ঘটাতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ। এসব উপেক্ষা করে শাসন চালিয়ে যাওয়া তো অসম্ভব ছিল বিএনপির জন্য। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি ১১৬ আসন পায়। আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরও সর্ববৃহৎ বিরোধী দল হিসেবে তারা এসে বসে সংসদে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কোনো কারণে দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়ে নির্বাচনে গেলে বর্তমানে ক্ষমতাসীনরা কি বিএনপির মতো শতাধিক আসন পাবে? সে ভরসা কি আছে? আওয়ামী লীগ সরকার নজিরবিহীনভাবে পরপর তিন মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে। মাত্র এক মেয়াদ ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন মোকাবিলা করতেও কতই না ভীত হয়ে পড়ে একেকটি সরকার! অভিজ্ঞতায়ও দেখা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো নির্বাচনে সদ্যবিদায়ী ক্ষমতাসীন দল আর সরকার গড়তে পারেনি। অন্যদিকে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলই পুনরায় সরকার গঠন করেছে। এসব পরিষ্কার জানা আছে বলেই বিরোধীদের দাবির কথা শুনতেও রাজি নয় ক্ষমতাসীনরা। তারা যেহেতু নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে এবং এরই মধ্যে দু-দুটি নির্বাচন পছন্দমতো সেরে ফেলে দেশটা চালিয়ে যেতে পেরেছে, সুতরাং তারা চাইছে সেভাবেই আরও একটি নির্বাচন করে ফেলতে।
অবশ্য এমনটাও বলা হচ্ছে, পারলে আন্দোলন করে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করুন– যেমনটা আমরা করেছিলাম! সরকারপক্ষের বদ্ধমূল ধারণা, তেমন আন্দোলন গড়ে তোলার সামর্থ্য বিএনপির নেই। নির্বাচনেরও আর বেশি বাকি নেই। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করতে বিএনপি ও তার মিত্ররা ‘আগুন-সন্ত্রাস’ করেছিল বলে জোর অভিযোগ রয়েছে। তাদের পক্ষে এখন সে ধরনের অন্দোলন রচনাও অসম্ভব বলে সরকার মনে করে। বিএনপির পক্ষ থেকেও চেষ্টা রয়েছে আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ ধারায় রাখার। তবে এ ধরনের আন্দোলনে ব্যাপক জনসমাগম হলেও এ দেশে সেটা ‘কার্যকর আন্দোলন’ হয়ে ওঠে না। সরকারও কোনো চাপ অনুভব করে না। প্রভাবশালী দেশ থেকে বিবৃতি বা নিষেধাজ্ঞা এলে বরং তাকে কিছুটা চাপে পড়তে দেখা যায়। কোনো কোনো দেশের বিষয়ে তো প্রকাশ্যে এমনও বলা হয়ে থাকে– তারা চাইলে আমাদের মতো দেশে সরকারের পতন ঘটাতে পারে!
এবার তেমন কিছু ঘটবে বলে সরকারপক্ষ অবশ্য মনে করছে না। দেশের ভেতর আন্দোলনের চাপে বেকায়দায় পড়বে বলেও মনে করছে না তারা। টানা মূল্যস্ফীতিসহ জনজীবনে যেসব সংকট রয়েছে, সেটা স্বীকার করে নিয়েও বলা হচ্ছে– এর পরও বিএনপি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। সাম্প্রতিককালে অবশ্য বড় কিছু বিভাগীয় সমাবেশ করতে সক্ষম হয়েছে বিএনপি। রাজধানীতে স্মরণকালের বৃহত্তম জমায়েতও ঘটাতে পেরেছে। আবার ধারাবাহিকতার অভাবও দেখা যাচ্ছে। বিএনপি নতুন করে ১২ দিনের কর্মসূচি দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে সমাবেশ ও রোডমার্চ। কিন্তু সরকার মনে হয় না, এতে সন্ত্রস্ত। বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাধাদান অবশ্য কমে এসেছে। বিশেষত বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে উৎসাহী বিদেশিদের নজরদারি বেড়ে ওঠার কারণে। তারপরও কোথাও কোথাও হামলা ও সংঘাত যে হচ্ছে না, তা নয়। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও এগুলো ঘটে গিয়ে থাকতে পারে। তবে বিএনপির আন্দোলনের ধারা দেখে কম লোকেরই মনে হচ্ছে, রাজপথে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, সরকার যা সামলাতে ব্যর্থ হবে।
এ অবস্থায় সরকারের একাংশের ধারণা, সরকার পতনের আন্দোলন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে এবং নিজ ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিএনপি শেষ মুহূর্তে ঠিকই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেবে। বিগত দুটি নির্বাচন ও মানবাধিকার ইস্যুতে সমালোচনামুখর প্রভাবশালী বিদেশি শক্তির নিবিড় নজরদারি অব্যাহত থাকার ভরসাতেও হয়তো নির্বাচনে আসবে বিএনপি। সরকারকে চ্যালেঞ্জে ফেলা কিংবা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টাও থাকতে পারে তাদের। তবে সরকারের দিক থেকে এ চাওয়াটাই স্বাভাবিক– দাবিতে অটল থেকে বিএনপি নির্বাচনে না আসুক। সরকার সে ক্ষেত্রে প্রায় নির্বিঘ্নে তার পুরোনো ও নতুন মিত্রদের নিয়ে নির্বাচনটা সেরে ফেলতে পারবে। ইতোমধ্যে ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। বলা হয়েছে, জনগণ ভোট দিতে এলেই সেটা অংশগ্রহণমূলক হবে। কত শতাংশ ভোট পড়লে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে, সে ব্যাপারেও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
এ অবস্থায় বিএনপি ও তার বিশ্বস্ত মিত্র বাদে অন্যদের নিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ একটি নির্বাচনের দিকেই সরকার এগোচ্ছে বলে খবর রয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এটা হবে ২০১৪ ও ’১৮ সালের নির্বাচনের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। এতে বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির বদলে নতুন কোনো দল, যেমন ‘তৃণমূল বিএনপি’র উত্থান ঘটানোর কথাও শোনা যাচ্ছে। বিএনপি যেমন সরকার পতনের আন্দোলনে এখনও ব্যর্থ; উল্লিখিত নির্বাচন প্রতিহত করতেও তারা ব্যর্থ হবে বলে মনে করছে ক্ষমতাসীনরা। তাদের এসব হিসাবই হয়তো সত্য এটা ধরে নিলে যে, প্রকৃত বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকলেও পশ্চিমারা সেটাকে গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নিয়ে পরবর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাবে। সম্প্রতি ইইউ পার্লামেন্ট থেকে বাংলাদেশের মানবাধিকার, নির্বাচন ও গণতন্ত্র বিষয়ে যেসব বক্তব্য এসেছে, এতে কিন্তু বোঝা যায়– তারা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম সিরিয়াস নয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য চলমান বাণিজ্যিক সুবিধা বহাল রাখা না-রাখার প্রশ্নও তারা তুলেছে। নির্বাচনের আগে ও পরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসবে না– সেটাও হলফ করে বলা যাচ্ছে না। এসব ঝুঁকি না থাকলে সুদীর্ঘ তিন মেয়াদে দেশের ভেতরটা গুছিয়ে রাখা সরকারকে অত না ভাবলেও চলত।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
- বিষয় :
- রাজনীতি
- হাসান মামুন