ঢাকা বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩

দশদিক

‘গ্রেনেডিয়ার’ থেকে ‘তালেবান’ ভিসি

‘গ্রেনেডিয়ার’ থেকে ‘তালেবান’ ভিসি

প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

চুপচাপ ভালোই চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ২০২২ সালেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এবং দেশজোড়া নিন্দার মুখে উপাচার্যের সিংহাসন হারানোর কথা ছিল তাঁর। কিন্তু কিছুটা সময় চেয়ে এবং একজন প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীর দূতিয়ালিতে সেবারের মতো তবিয়ত বহাল রাখেন। কিন্তু এবার বেফাঁস কথা বলে জাতির নজর কাড়লেন। ‘ওপেন’ কালচারের বিপরীতে ‘তালেবান’ কালচারের জয়গান গাইলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে অনেকেরই মনে পড়ল, আরে তালেবান স্টাইলে ক্যাম্পাস চালানোর অভিযোগ তো তাঁর বিরুদ্ধে উঠিয়েছিল শিক্ষার্থীরা।

ইনিই তো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ভিসি, যিনি শিক্ষার্থীদের খাদ্য আন্দোলন ঠেকাতে সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট, টিয়ার শেল মারা ও লাঠিপেটা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এতে ৪০ জনের বেশি শিক্ষার্থী আহত হয়। পরে আমরণ অনশনে একের পর এক পড়ুয়া যখন স্যালাইন নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে, আর তিনি উপাচার্যের ক্ষমতার দম্ভে যা-খুশি তাই বলে যাচ্ছিলেন। মনে পড়ে তাঁর আপত্তিকর সেই কথাটাও, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের কেউ বিয়ে করে না’। এ রকম নারীবিদ্বেষী এবং আত্মস্বীকৃত মানুষকে উপাচার্যের পদে দেখতে লজ্জা লাগে।

এর মধ্যে ১২০০ কোটি টাকার বেশি খরচের দুটি উন্নয়ন প্রকল্প: অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প-১ এবং উন্নয়ন প্রকল্প ২; এগুলোর প্রথমটির কাজের মেয়াদ ছিল ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত। দ্বিতীয়টির মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত– পরে অবশ্য আরও ছয় মাস মেয়াদ বাড়ে। এখন আরও তিন বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই ১২০০ কোটি টাকার বেশি বরাদ্দের প্রকল্পগুলো যে এখনও তিন বছরের জায়গায় ছয় বছর লাগছে, সেই হিসাব কে দেবে? এখন যদি মূল্যস্ফীতির দোহাইয়ে প্রকল্পের খরচ আরও বাড়ানো হয়, তার দায় কে নেবে?

প্রতিপক্ষ তাঁর নাম দিয়েছিল ‘বোমা ফরিদ’। এখন নতুন নাম হয়েছে ‘তালেবান ফরিদ’। তিনি সেই বিরল প্রতিভাদের একজন, যিনি গার্মেন্টস ব্যবসায়ী থেকে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন। তাঁর রেকর্ড আরও আছে। কোনো পিএইচডি ডিগ্রি ছাড়াই তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বিএনপি আমলের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের বরপুত্র ছিলেন তিনি। উপাচার্যকুলের তিনি শিরোমণিও বটে। ২০২২ সালে সে সময়কার ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ জন উপাচার্য ভিসি ফরিদের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ফরিদ সাহেব না থাকলে আমরাও পদত্যাগ করব। এঁদের মধ্যে ছিলেন উন্নয়ন কাজের টাকা ভাগাভাগির অভিযোগে অভিযুক্ত এবং হাতুড়ি বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকেরাও। এঁদের ২১ জনের বিরুদ্ধে ইউজিসি দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত করেছিল।

ফরিদ আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত তথ্য অধিকারবিষয়ক সেমিনারে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, ‘সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়, এখানে (শাবিপ্রবি) ওপেন কালচার ছিল, ছেলেমেয়েরা যা খুশি, তাই করতে পারত। কেউ কিছু বলতে পারত না। কারণ, তাদের বয়স ১৮ বছর। কিন্তু আমি বলেছি, সাড়ে ১০টার মধ্যে হলে ঢুকতে হবে। তারা (শিক্ষার্থীরা) এটার নাম দিয়েছে তালেবানি কালচার। তালেবানি কালচার নিয়ে আমি খুবই গৌরবান্বিত, এটা নিয়ে থাকতে চাই। আমি ওপেন কালচার চাই না।’


শুনে মনে হবে, তিনি তো দায়িত্বশীল অভিভাবকের মতোই কথা বলেছেন। অথচ ২০২২ সালের শুরুতে আন্দোলন শুরু করেছিল ‘ওপেন কালচারের’ দাবিতে বা রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত হলের বাইরে থাকার জন্য নয়। তারা আন্দোলনে নেমেছিল হলের সিট, পানি, খাদ্য, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন জরুরি সমস্যার সমাধানে। সমাধানের বদলে হল প্রভোস্টের বাজে আচরণের প্রতিবাদ করে। সেখানে ওপেন কালচারের কোনো কথা ছিল না। সেই আন্দোলনে নিপীড়ন নেমে এলে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, উপাচার্য ‘তালেবান স্টাইলে ক্যাম্পাস চালাচ্ছেন’। সেই অভিধা এখন নিজেই তিনি বরণ করে নিলেন। যেমন তিনি বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগের কমিটি আমিই ভেঙে দিয়েছি’। তিনি কি ছাত্রলীগের সভাপতি?

যাহোক, শিক্ষার্থীদের ঘৃণা, দেশজুড়ে নাগরিকদের প্রতিবাদ, সংবাদমাধ্যমে ওঠা অভিযোগে লজ্জা পেলেন না উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। লজ্জাই নাকি সভ্যতা। লজ্জা ছাড়া মানুষ হিংস্র হতে পারে; অমানবিক হতে পারে। লজ্জার মাথা না খেলে কেউ দেশ ও জাতির মাথা খাওয়ার চেষ্টা করতে পারে না। লজ্জা গণতন্ত্রেরও শর্ত। জিল লক নামে এক আমেরিকান ভদ্রলোক Democracy and the Death of Shame (গণতন্ত্র ও লজ্জার মৃত্যু) নামে বই লিখেছেন। সমাজ থেকে লজ্জা উঠে গেছে বলে যখন মানুষ আহাজারি করে, তখন বুঝতে হবে যে জনতা অসন্তুষ্ট। মানুষ লজ্জার ভয়ে অনেক অপকর্ম করে না। দুর্নীতি, অপরাধ, অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকে মানুষ যদি লজ্জা-ফ্যাক্টর কাজ করে মনে। এসব প্রকাশ পেলে লোকে কী বলবে, কেমন করে মানুষের সামনে দাঁড়াব, কেমন করে ছেলেমেয়ে, মা-বাবা, স্ত্রী-স্বামীর মুখোমুখি হব– এসব চিন্তা যার মাথায় কাজ করে, তার পক্ষে লজ্জাকর কাজ করা কঠিন।

কয়েক দিন আগে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত গণমাধ্যমের সামনেই বলে ফেললেন, ‘গণতন্ত্রকে আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না।’ ভূতও মুখে রামনাম করে; চরম অগণতান্ত্রিক নেতাও মুখে মুখে গণতন্ত্রের গান গেয়ে চলেন। কিন্তু আবুল বারকাত সেটুকু ভান বা লজ্জাও বোধ করলেন না। পশুপাখির সামনে কেউ লজ্জা পায় না। সাধারণ মানুষকে হয়তো তাঁরা পশুপাখিই মনে করেন।

একজন ব্যক্তি, শিক্ষকতাকালে যাঁর রেকর্ড ভালো ছিল না, যাঁর কোনো পিএইচডি ডিগ্রি পর্যন্ত নেই, তাঁকে কেন লজ্জার মাথা খেয়ে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বানাতে হবে?

আর সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জনতা ব্যাংকের ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ লোপাটের জন্য যাঁকে দায়ী করেছেন, তিনি কোন মুখে ‘গণতন্ত্রকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না’ বলে ঘোষণা দেন? মুহিত সাহেব বলেছিলেন, ‘জনতা ব্যাংক একসময় সেরা ব্যাংক ছিল। কিন্তু আবুল বারকাতই ব্যাংকটি শেষ করে দিয়েছেন’ (প্রথম আলো, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)।

‘গ্রেনেডিয়ার’ ভিসি এবং গণতন্ত্রবিরোধী অর্থনীতিবিদরা যদি নিজেরা লজ্জিত না হন, তাহলে তো লজ্জা আমাদেরই। লজ্জার বোধ যদি নিজের না থাকে তাহলে জোর করে কি কাউকে লজ্জা দেওয়া যায়?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক এবং সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক

faruk.wasif0@gmail.com

আরও পড়ুন