ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

ওটিটি সিরিজ

সেন্সরশিপ: মরবে কিন্তু পচবে না

সেন্সরশিপ: মরবে কিন্তু পচবে না

উম্মে রায়হানা

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

যে দেশে বদ্ধ পানিতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে তিনজন মানুষ নিহত হন, সে দেশে বসে বৃষ্টি উপভোগ করা বিলাসিতা। অনেক মানুষ যাচ্ছে বানের জলে ভেসে। কাজেই আনন্দ খুঁজতে আশ্রয় নিতে হয় স্টার সিস্টেমের। সিনেমায় স্টার সিস্টেম নিয়ে আসে হলিউড, গত শতাব্দীতে। আজকে আমার পছন্দের তারকাদের সম্পর্কে খবর আছে পত্রিকায়; তবে হলিউডের নয়, বলিউডের। ছাপা কাগজেও নয় অবশ্য, অনলাইনে। নিউজ বলছে, ডন থ্রি থেকে শাহরুখ খানকে বাদ দিয়ে রণবীরকে নিচ্ছেন নির্মাতা ফারহান আখতার। নিঃসন্দেহে মজার খবর– দু’জন বড় স্টার, একজন বাচ্চা স্টার। এ নিউজ পড়তে গিয়েই ডিভাইসের পর্দায় চোখে পড়ল আরেকটি খবর– পরীমণি অভিনীত ‘পাফ ড্যাডি’ ওয়েব সিরিজ বন্ধে আইনি নোটিশ।

 নিউ মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে সাংবাদিকতার ধরন আর খবর উপস্থাপনের কায়দা বদলে যাবে; এটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে হা-হুতাশ করার খুব বেশি অর্থ হয়তো হয় না। কিন্তু কিছু তথাকথিত বিনোদন সংবাদ শিরোনাম পড়ে আক্ষরিক অর্থেই গা রি রি করে ওঠে। এই স্টোরিটা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমূল্য বহন করে। এটা এ জন্য নয় যে, এতে পরীমণি অভিনয় করেছেন। বরং অভিনেত্রীর তারকাখ্যাতি ব্যবহার করে নিউজটার মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছেন বিনোদন সাংবাদিকরা; আমার আপত্তি ঠিক ওইখানে।

পাফ ড্যাডি ওয়েব সিরিজ মাত্রই মুক্তি পেয়েছে; নামও জানতাম না। ট্রেলার দেখে যা বুঝলাম– এটা আর দশটা ওটিটি সিরিজের মতোই। সমাজ ও সময় নিয়ে তৈরি। ক্ষমতা, পৌরুষ, শৌর্য-বীর্য, বীরভোগ্যা বসুন্ধরার গল্প। তাতে অনুষঙ্গ হিসেবেই নারীর উপস্থিতি, যেমনটা থাকে মুম্বাইয়ের মাফিয়া ছবিগুলোতেও। এখানে পরীমণির বদলে যে কোনো অভিনেত্রীই থাকতে পারতেন। কিন্তু শিরোনামে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এই তারকার নাম। এটুকু বুঝতে সিরিজ দেখার প্রয়োজন পড়ে না, ট্রেলার দেখাই যথেষ্ট।

এই সিরিজের বিরুদ্ধে যে আইনি নোটিশ জারি করা হয়েছে তাতে আইনজীবী বলেন, ‘পাফ ড্যাডিতে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ককে প্রমোট করা হয়েছে। পাশাপাশি বিয়েতে অনুৎসাহিত করা, আধ্যাত্মিক মনীষীর চরিত্রকে অত্যন্ত বাজেভাবে হরণ করা, প্রতি মুহূর্তে যৌন সুড়সুড়ির দৃশ্য উপস্থাপন করা হয়। এ ছাড়া ওই মুভিতে আর কোনো বার্তা নেই।’

এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের একটি বাণী বা উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর লেখা বা নির্দেশিত কোনো নাটক বা সিনেমা প্রসঙ্গে এ রকম সমালোচনা উঠেছিল একবার। নিন্দুকেরা দাবি করেছিল, হুমায়ূন আহমেদের লেখায় শিক্ষামূলক কিছু নেই। এর পর হুমায়ুন আহমেদ এক সাক্ষাৎকারে অতি বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তক থেকে কিছু শিখতে চাই না। আমরা শিখতে চাই নাটক-সিনেমা-গল্প-উপন্যাস থেকে।

উল্লিখিত সিরিজের ট্রেলার দেখে বোঝা গেল, ভিলেন বা খলনায়কদের মধ্যে একজন পীর বা গুরুবাবা ধরনের পুরুষ আছেন, যিনি আধ্যাত্মিকতার ছদ্মবেশে ক্ষমতা ও লাম্পট্যের চর্চা করেন। দুঃখজনক হলেও কিছু করার নেই; আমাদের সাহিত্য ও সিনেমায় আধ্যাত্মিক সাধুদের মোটা দাগে উপস্থাপন এ রকমই। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু, হাসান আজিজুল হকের গুণিন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অহিংসা ছাড়াও বিস্তর উদাহরণ রয়েছে। নাটক-সিনেমাতেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

এই ভূখণ্ডে ফকির, সন্ন্যাসী, বাউল, পীর, দরবেশ, সাধু প্রকৃতির মানুষের দার্শনিক ও রাজনৈতিক দিক মানুষজন তেমনভাবে জানেন না। সংসারত্যাগী সাধু পুরুষদের নিয়ে গল্পগাথায় রহস্য আর লাম্পট্যই প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে যৌনতা, নারীর শরীর প্রদর্শন বা সাধুর চরিত্র হরণ/হনন কোনো প্রসঙ্গেই এ নোটিশ ধোপে টিকবে না। কিন্তু আমার মূল প্রসঙ্গ প্রকৃতপক্ষে এ নিউজ বা এ সিরিজটি নয়। বরং আইনি নোটিশ দেওয়ার এই যে প্রবণতা– এই নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন।

ওটিটি বা ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্ম দুনিয়াজুড়ে প্রচলিত এবং জনপ্রিয়। ওটিটিতে সেন্সর বলে কিছু থাকে না, কিন্তু রেটিং দেওয়া থাকে। দেওয়া থাকে ডিসক্লেইমারও। এখন পৃথিবীর এমন কোনো দেশের এমন কোনো কনটেন্ট নেই, যা মানুষ ঘরে বসে ব্যক্তিগত ডিভাইসে দেখতে পাচ্ছেন না। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, চরকি, বঙ্গ, হইচই– এমন দেশি-বিদেশি নানা প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। সেন্সর বোর্ড উঠে যাওয়ায় নির্মাতারা কল্পনার ডানায় ভর করে আকাশে উড়তে শুরু করেছেন। গল্পের ছলে এমন সব বার্তা তারা দিয়ে যাচ্ছেন, যা সেন্সর বোর্ডের কাঁচির তলায় পড়লে কোনোদিন আলোর মুখ দেখতে পেত না।

পরীমণি অভিনীত পাফ ড্যাডি ওয়েব সিরিজের একটি দৃশ্য

যেমন কিছুদিন আগেই ‘ভাইরাস’ নামে একটি বাংলাদেশি ওয়েব সিরিজ মুক্তি পেয়েছে। তাতে অনেকটা ঈশপের গল্পের মতো পাপ-পুণ্য-কর্মফল ইত্যাদি মিথকে ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন পর্বে হাজির করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গল্প। এর মধ্যে একটি গল্প মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। এই ডিস্টোপিয়ান কাহিনিতে দেখা যায়, একটা গ্রামের সব মানুষ ফরমালিনে আসক্ত। খাদ্যে ফরমালিন না থাকলে তারা আর সে খাদ্য গ্রহণ করতে পারেন না। তারা না খেয়ে মরে যান কিন্তু তাদের দেহগুলো পচে না; কারণ তাদের শরীরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফরমালিন। আমি নিশ্চিত, সেন্সর ব্যবস্থা চালু থাকলে এমন সময়োপযোগী একটি বিষয় নিয়ে এ রকম ফ্যান্টাসিধর্মী গল্প মন খুলে দেখাতে পারতেন না নির্মাতা। সহিংসতার দৃশ্য দেখানোর অভিযোগে কাঁচি চালানো হতো তাঁর চিত্রায়িত দৃশ্যে। বছর দুয়েক আগে নেটফ্লিক্সের বানানো ‘প্ল্যাটফর্ম’ ছবিটা পৃথিবীর কোনো দেশের সেন্সর থেকেই মুক্তি পেতে পারত কিনা সন্দেহ!

দুনিয়াজুড়ে যেখানে সিনেমায় সেন্সর বলে কোনো কিছু আর থাকছে না, সেখানে অতি নগণ্য কারণ ধরে সিনেমা বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানানো অত্যন্ত পশ্চাৎপদতার লক্ষণ। উল্লেখ্য, এর আগে গত এপ্রিলে অভিনেত্রী প্রভাকেও আইনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন আইনজীবী জয়নাল আবেদীন মাযহারী। যে ঘটনার প্রসঙ্গে এই লেখার উৎপত্তি, সেই পাফ ড্যাডি সিরিজের জন্য ই-মেইলের মাধ্যমে ও ডাকযোগে পাঠানো আইনি নোটিশ যাদের পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বঙ্গ বিডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান।

লক্ষ্য করার মতো বিষয়, এ আইনি নোটিশে পরীমণির নাম নেই। থাকার কথাও নয়; তিনি কুশীলব মাত্র। অথচ সংবাদ শিরোনামে এসেছে তাঁর নাম ও ছবি। এ থেকে শুধু সেই আইনজীবী নন; নারী তারকাদের প্রতি বিনোদন সাংবাদিকদের মনোভাবও বুঝতে পারা যায়। আত্মহত্যা করার পর কলকাতার বালিকা বধূখ্যাত এক অভিনেত্রীর বালিকা বধূ সাজা ছবি না দিয়ে অনাবৃত কাঁধের ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল। সিনেমায় নটনটী নির্বিশেষে সবাই সুতোয় বাঁধা পুতুলমাত্র। কিন্তু এ পুরুষতান্ত্রিক পদ্ধতির সঙ্গে অনেক লড়াই করে অভিনেত্রীরা কাজ করেন। অথচ আমরা তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে ভীষণ কার্পণ্য করি; এমনকি তাদের মৃত্যুর পরও।

যে নিউজ নিয়ে এত কথা, সেই নিউজকে শুধু এই নির্দিষ্ট সিরিজের পাবলিসিটি স্টান্ট না বানিয়ে নির্মাতাদের সৃষ্টির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখানো প্রয়োজন ছিল। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আসায় কেবল নির্মাতাদের নয়; মুক্তি ঘটেছে দর্শকদেরও। তারা খুঁজে পাচ্ছেন নিজের আগ্রহের উপযুক্ত কনটেন্ট। যে দেশে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বলতে তেমন কিছু নেই; একের পর এক সিনেমা হলগুলো ভেঙে তৈরি হচ্ছে শপিং মল; বেঁচে থাকা হলগুলোয় চলছে বলিউডের হিন্দি ছবি; সেই দেশের মানুষের জন্য ওটিটি খুবই লাগসই বিকল্প। এই দেশে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি মরা, কিন্তু সেন্সর বোর্ড অতি জাগ্রত। সেখানে সেন্সর বোর্ডকে ডেকে এনে সিনেমা দেখার খোলা জানালা বন্ধ করে দেওয়ার এই চেষ্টা নিন্দা জানানোর মতোই। আশা করি, আদালত এ নোটিশ খারিজ করে দেবেন ও ফিল্মটি চলা অব্যাহত থাকবে।

উম্মে রায়হানা: কবি ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন