জন্মদিন
আঁধারে তুমি আলোক শিখা

এনামুল হক শামীম
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
আজ ২৮ সেপ্টেম্বর। বঙ্গবন্ধুর বীরকন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন। কবি হাসান হাফিজুর রহমান জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, ‘আপনিই তো বাংলাদেশ।’ আসলেই তিনিই (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশ। কারণ তাঁর কারণেই বাংলাদেশের অর্জন এখন সারা দুনিয়ার নজরকাড়া। নজর কেড়েছেন তিনিও। তিনি বিশ্বনেতার তালিকাভুক্ত। জাতিসংঘের অধিবেশন, ভারতে অনুষ্ঠিত জি২০ সম্মেলন ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন পর্যবেক্ষণ করলেই সে চিত্র দেখতে পাই। বিশ্বনেতারা যেভাবে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে সম্মান দেখান, তাতে জননেত্রী শেখ হাসিনার একজন কর্মী হিসেবে এবং বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে গর্ব বোধ করি।
তিনি সত্যিকার অর্থেই বাঙালির অতি আপনজন। তাঁর সংগ্রামমুখর জীবন বাংলাদেশেরও উত্থান-পতনের ধারাবাহিকতার ইতিহাস। সহজ-সারল্যে ভরা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। পোশাক-আশাক, জীবনযাত্রা- কোথাও কোনো প্রকার বিলাসিতা বা কৃত্রিমতার ছাপ নেই। এ যেন পিতার মতোই বাংলার মাঠ-ঘাট থেকে উঠে আসা বাংলার মেয়ে। মেধা, যোগ্যতা, সততা, সাহস দিয়ে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
বদলে দেওয়া বাংলাদেশের রূপকার, সবার মধ্যমণি জননেত্রী শেখ হাসিনা, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার পর যাঁর নেতৃত্বে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে হাঁটছি। জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে দেশের নেতৃত্ব থাকলে ২০৪১ সালের আগেই বাংলাদেশ হবে বড় অর্থনীতির দেশ। শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্বের কোটি কোটি বিপন্ন মানুষের মর্মবাণী আজ উচ্চারিত হচ্ছে তাঁর কণ্ঠে। স্বজন হারানোর চিরবেদনায় কাতর হয়েও তিনি মানুষের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর অদম্য পথ চলাই তাঁকে গন্তব্যের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে।
হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ ঘুচিয়ে বাংলাদেশ আজ ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার আশ্রয়দাতা। শুধু তাই নয়; তাদের অন্ন-বস্ত্র- চিকিৎসারও জোগানদাতা এই বাংলাদেশ। তাই বঙ্গবন্ধুকন্যা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’। সরকারি অর্থায়নে পাকা ঘরসহ বাড়ি দিচ্ছেন ভূমিহীনদের, যা বিশ্বে নতুন নজির। তবে উন্নয়নের এই মহাসড়কের যাত্রাটা সবসময় কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এসেছে অনেক বাধা-বিপত্তি। এসব বাধা-বিপত্তিকে আপনি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন; গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন অদম্য সাহসিকতায়। পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করার। আপনি সেই ষড়যন্ত্রের মুখে কুঠারাঘাত করেছেন। জঙ্গির বংশকে করেছেন নির্মূল।
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই করোনা মহামারির মধ্যেও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এশিয়ার প্রায় সব দেশের ওপরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক নেতৃত্ব, সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে মহামারি করোনা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সময় মানুষের জন্য আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা, অর্থনীতিকে বাঁচাতে প্রণোদনা ঘোষণা এবং বাস্তবায়নের কারণে দেশে অনাহারে একজন মানুষেরও মৃত্যু হয়নি; খাদ্যের জন্য কখনও কোথাও হাহাকার হয়নি।
জাতির পিতার বীরকন্যা ক্ষমতায় এসেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন করা, সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি এবং সমুদ্রে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্লু ইকোনমির নতুন দিগন্ত উন্মোচন, ভারতের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ও ছিটমহল বিনিময়, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয়, সাবমেরিন যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো চার লেনে উন্নীত করা, এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, মানুষের গড় আয়ু ৭৪ বছর ৪ মাসে উন্নীত, দলিলসহ লাখ লাখ ভূমিহীন-গৃহহীনকে আপন ঠিকানার ব্যবস্থা করা, নিজস্ব অর্থায়নে সারাদেশে ৫৬৪টি দৃষ্টিনন্দন মডেল মসজিদ নির্মাণ, যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিনেই প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতিদান, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রতিটি জেলায় একটি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারী নীতি প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ফাইভজি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে কালোত্তীর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে আগে বর্ষায় হাজার হাজার মানুষ নদীভাঙনে তাদের ভিটেমাটি হারাত। জননেত্রী শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কাজ করে নদীভাঙন এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে এনেছেন।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্বে থাকা শেখ হাসিনা ৪২ বছর ধরে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আপসহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের রাজনীতির মূল স্রোতধারার প্রধান নেতা হিসেবে শুধু উপমহাদেশে নয়; বিশ্বনেতাদের নজর কাড়েন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক জোট-দল ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয়ী হয়। অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম শেষে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয় এবং ক্ষমতায় এসেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে। আইনি বাধা অপসারণের জন্য সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সেই কালো আইন ও কলঙ্কময় অধ্যায় ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিতকরণ বিল’ সপ্তম সংসদে উত্থাপন করেন। ওই বছর ১২ নভেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয় এবং ১৪ নভেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। এর ফলে বিশ্বাসঘাতক খুনি জিয়া-মোশতাকের মাধ্যমে জারি করা এবং মেজর জিয়াউর রহমানের সময় বৈধতা পাওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হয়। অধ্যাদেশটি বিলুপ্তির মাধ্যমে শুরু করেন বাঙালি জাতির কলঙ্ক মোচনের কাজ। স্বাধীনতাকামী বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে বাংলাদেশের অশুভ ছায়া যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধী, চিহ্নিত রাজাকারদের বিচারের মাধ্যমে স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্মকে অভিশাপমুক্ত করেন একমাত্র শেখ হাসিনা।
১৯৮১ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে না এলে ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতো না। ইতিহাসের নৈবেদ্য সাজানো, যেটা হচ্ছে সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন; সেটা বাস্তবায়ন হতো না। তাঁকে ঘিরে এগিয়ে যেতে হবে। সেদিন যে আশা নিয়ে নেত্রীকে স্বাগত জানিয়েছিলাম, সেসব প্রত্যাশা এখন পূরণ হচ্ছে। মানুষ ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরে পেয়েছে। ভূমিহীন ও গৃহহীনরা খুঁজে পেয়েছে আপন ঠিকানা। উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ। শুধু কি তাই? রাজনীতিতেও এসেছে গুণগত পরিতর্বন। কারণ জাতির পিতার হত্যার পর সামরিক শাসকরা রাজনীতিকে কলুষিত করেছিল। গণতন্ত্রকে করেছিল নির্বাসিত। বঙ্গবন্ধুকন্যা তাঁর দৃঢ় ও আপসহীন নেতৃত্বে গণতন্ত্রকে শৃঙ্খলমুক্ত করেছেন। ফিরিয়ে এনেছেন ভোটের অধিকার। ছবিসহ ভোটার তালিকা, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স তাঁরই দাবি ছিল। জেনারেল জিয়া ও খালেদা জিয়া ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। ছাত্রদের বিপদে ঠেলে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে জননেত্রী শেখ হাসিনা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ঐতিহাসিক ছাত্র মহাসমাবেশে ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে বই-খাতা-কলম তুলে দিয়ে বলেছিলেন– অস্ত্র নয়; বই-খাতা-কলম হচ্ছে ছাত্রলীগের হাতিয়ার। ঐতিহাসিক সেই মহাসমাবেশে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলাম আমি (তখন আমি ছাত্রলীগের সভাপতি)।
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন একজন রাজনীতিক, যিনি মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠান; আবার নিভৃত পল্লিতে একজন বিধবা নারী, স্বামী পরিত্যক্ত, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ভাতা পেলেন কিনা, কোনো ভূমিহীন ঘর পেলেন কিনা, সেটারও খোঁজখবর রাখেন। তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কাজ করেন। সে কারণে শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়ন শুরু করেছেন।
শেখ হাসিনার পরবর্তী ইতিহাস একুশ শতকের অভিযাত্রায় তিনি কীভাবে বাঙালি জাতির কাণ্ডারি হয়েছেন, তারই ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বপ্ন রূপায়ণের দায়িত্ব নিয়ে বাঙালি জাতির আলোর দিশারি হওয়ার ইতিহাস। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে তাঁকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ওই বছর ১৭ মে দীর্ঘ ৬ বছর প্রবাসজীবনের অবসান ঘটিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি ১৯৯০ সালের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে এবং সে বছরের ২৩ জুন প্রথমবারের মতো তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও ওই হামলায় ২৪ জন নিহত এবং ৫০০ নেতাকর্মী আহত হন।
শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্য অন্তঃপ্রাণ শেখ হাসিনা লেখালেখিও করেন। তাঁর লেখা এবং সম্পাদিত গ্রন্থ ৩০টিরও বেশি। প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে– ওরা টোকাই কেন, শেখ মুজিব আমার পিতা, সাদা কালো, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম, দারিদ্র্য দূরীকরণ, আমাদের ছোট রাসেল সোনা, আমার স্বপ্ন আমার সংগ্রাম, সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বিপন্ন গণতন্ত্র, সহে না মানবতার অবমাননা, আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি, সবুজ মাঠ পেরিয়ে ইত্যাদি। শুভ জন্মদিন বঙ্গবন্ধুর বীরকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আল্লাহ আপনার দীর্ঘায়ু দান করুন, আমিন।এনামুল হক শামীম: উপমন্ত্রী, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়; সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও সাবেক ভিপি, জাকসু
- বিষয় :
- জন্মদিন
- এনামুল হক শামীম