রাজনীতি
সরকারের ঝোঁক ও দেশের ঝুঁকি

হাসান মামুন
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশের জন্য নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির প্রয়োগ শুরুর ঘটনায় অবাক হওয়া যাবে না। তারা আমাদের নির্বাচন ঘিরে যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির সময় থেকে– এ হলো তারই ধারাবাহিকতা। ভিসা নীতি গৃহীত হয়েছিল প্রয়োগের জন্যই। তবে এটা যে নির্বাচনের আগেই ঘটবে, তা সুনিশ্চিত ছিল না। কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে নির্বাচনের পর। ওখানে কেমন নির্বাচন হয়ে আসছে, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট ধারণা ছিল। বাংলাদেশ তো কম্বোডিয়া নয়। এখানে কমপক্ষে চারটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইতিহাস রয়েছে। আছে নির্বাচনের আগে দলনিরপেক্ষ সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের দৃষ্টান্ত। নতুন পরিস্থিতিতে ওই ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি তাই অদ্ভুত নয়। তবে ঠিক কেমন সরকারের অধীনে নির্বাচনটি হওয়া দরকার, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য নেই। সবকিছুর পরও এটা নিয়ে তাই সরকারের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ করার অবস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরছে না; এটা বরং দৃঢ়তর হচ্ছে। নির্বাচনের আগেই ভিসা নীতির প্রয়োগ শুরুর ঘটনায় তা স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে হয়ে যাওয়া দুটি নির্বাচনে দায়িত্বশীলদের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বোধহয়। তপশিল ঘোষণার আগে নির্বাচনের বর্তমান পরিবেশ আর প্রক্রিয়া বিবেচনায় নিয়েও ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে নিশ্চয়ই। এ ক্ষেত্রে ভুলত্রুটি হতে পারে; তবে এর বার্তাটিই বড় করে দেখার বিষয়।
এর আগে ইইউ পার্লামেন্টের অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে এখানকার মানবাধিকার, নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে। এর সঙ্গে ইইউভুক্ত ২৭টি দেশে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বহাল রাখা-না রাখার প্রস্তাবও তুলেছেন তারা। আমাদের তো জিএসপি-প্লাসও পাওয়ার কথা। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা ঠিকই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কোনো শুল্ক সুবিধা না পেলেও ওখানে ভালো অবস্থায় যেতে পেরেছি। বাংলাদেশ কিন্তু তাদের নয়া জিএসপিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি জানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে সম্প্রতি। এর সঙ্গে আগামী নির্বাচন ঘিরে দেশটির অবস্থানের কোনো সম্পর্ক নেই বলেই মনে হচ্ছে। এটা অবশ্য বলা যাবে না– তারা ইইউর মতো করে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ঘিরে সামনে কোনো প্রশ্ন তুলবে না। তবে পশ্চিমারা আমাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায় না বলেই সাধারণভাবে মনে হয়। অন্য কোথাও থেকে একই দামে পণ্যসামগ্রী তারা পাবে না, তা তো নয়। প্রতিযোগী দেশগুলোও এমন সুবিধা কেড়ে নিতে মুখিয়ে থাকে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বাংলাদেশের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হয়েই থাকতে চাইবে। তারা আমাদের প্রধান উন্নয়ন সহযোগীও। সঙ্গে আছে কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মতো দেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কৌশলগত স্বার্থও তাদের রয়েছে। বাংলাদেশ পশ্চিমা ধরনের গণতন্ত্র চর্চার দেশ হিসেবে আরও এগিয়ে গিয়ে বিশ্বস্ত বন্ধুতে পরিণত হোক, এটা তারা স্বভাবতই চাইবে। এই চাওয়ার জায়গায় বিশ্বের প্রধান শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আছে সবচেয়ে এগিয়ে। তার ভূমিকা তাই সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের জনগণ কী চায়, সে আলাপটা কমই হচ্ছে দুর্ভাগ্যবশত। আগামী নির্বাচন ও জাতীয় গন্তব্যের প্রশ্নে তার প্রত্যাশার কোনো দাম নেই যেন। অথচ দেশটি তাদের এবং নির্বাচনেরও সবচেয়ে বড় অংশীজন হলো জনগণ। তাদের অর্ধেকেরও বেশি ভোটার এবং নতুন ভোটারের একটা বিরাট অংশ বিগত দুটি নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচন ঠিকমতো হলে তারা বিপুলভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগে এগিয়ে আসবে বৈকি। অথচ কেউ জিজ্ঞেস করছে না– কেমন নির্বাচন তারা চায়। বিগত দুটির মতো নির্বাচন কি কোনো বিবেকবান মানুষ চাইতে পারে? ‘দলীয় ভোটার’ অবশ্য অনেক রয়েছে। তারা তাদের মতো করে নির্বাচন চাইবে। সেদিক থেকে দেখলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাইবে। এটাই স্বাভাবিক। এ জায়গাটায় পশ্চিমাদের সঙ্গে তাদের আকাঙ্ক্ষা এসে মিলছে, যা উপেক্ষা করা কঠিন। উপেক্ষা অবশ্য করা যাচ্ছে– বিরোধী দল দীর্ঘদিনেও ব্যাপক মানুষকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলনের চাপ সৃষ্টিতে ব্যর্থ বলে। সে জন্য বিরোধী দলও তার দাবি আদায় করতে পারছে না। উল্টো অব্যাহত চাপের মুখে থাকতে হচ্ছে তাদের। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচন ঘিরে পশ্চিমাদের আগ্রহভরে এগিয়ে আসার ঘটনায় বিরোধী দলসহ জনগণের বড় অংশের উৎসাহ পরিলক্ষিত হচ্ছে।
দেশের ভেতর ও বাইরের এমন চাপের মধ্যেও সরকার তার পরিকল্পনামতো নির্বাচন সেরে ফেলার পথেই এগোচ্ছে অবশ্য। ভিসা নীতির প্রয়োগ শুরুর ঘোষণায় সরকারের তরফ থেকে এ পর্যন্ত যা বলা হয়েছে, তাতে নির্বাচন ঘিরে নতুন চিন্তার কোনো লক্ষণ নেই। এতে ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে এমনভাবে বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, যাতে আগের ধারায় নির্বাচন করে ফেলার মনোভাবটিই স্পষ্ট। ভিসা নিষেধাজ্ঞায় যা ক্ষতি হওয়ার হোক; দেশের ভেতর তো নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখতে হবে– এটাই তাদের মনোভাবের সারবস্তু। অভিজ্ঞতার নিরিখে তারা আবার দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল– সরকারকে বিপাকে ফেলার মতো আন্দোলন সামনের দিনগুলোতেও গড়ে তুলতে পারবে না বিএনপি। এই ফাঁকে নির্বাচনটি সেরে ফেলা যাবে। বিএনপি ও তার মিত্রদের বাদে অন্যদের অন্তর্ভুক্ত করে নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ হিসেবেও দেখানো যাবে বলে তাদের ধারণা। নির্বাচন মোটামুটি ‘শান্তিপূর্ণ’ রাখা গেলে পশ্চিমাদের বলা যাবে, আমরা তো সহিংসতাও হতে দিইনি।
সেটা হয়তো করা যাবে এ কারণেও, বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে রয়েছে এবং এটা তারা বজায় রাখবে। ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া’ বাধাগ্রস্ত করলে বিরোধী দলকেও ভিসা নীতির আওতায় পড়ার কথা। তবে তারা বলতে পারে, আমরা তো ‘সাজানো নির্বাচন’ ঠেকাতে চাইছি। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ তপশিল ঘোষণার আগে বা পরে আর কোনো পদক্ষেপ নেবে না– সেটাও বলা যায় না। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অবশ্য তেমন আশাবাদই ব্যক্ত করেছেন। এর প্রতিফলন ঘটিয়ে পশ্চিমারা বসে থাকতে নাও চাইতে পারে। ইইউ ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, তারা পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। যেমন নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে এতে রয়েছে তাদের অনাস্থার বার্তা। প্রয়োগ শুরু হয়ে যাওয়া ভিসা নীতিতেও রাষ্ট্রের এমন কোনো অংশ বোধহয় নেই, যাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এসব পদক্ষেপে স্পষ্ট– পশ্চিমাদের ধারণা, এখানে একটি কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাই গড়ে উঠেছে।
এখন আরেকটি একতরফা নির্বাচন সেরে ফেলে এটিকে কি স্থায়ী করা হবে? এ প্রশ্নে ভারতের আনুষ্ঠানিক অবস্থান এখনও মেলেনি, যা আমাদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে পশ্চিমাদের একাংশের সম্পর্ক কিন্তু হয়ে পড়েছে গোলমেলে। আগামী নির্বাচন ঘিরে জনগণসহ পশ্চিমা প্রত্যাশার সমতলে ভারত কতটা আসতে পারবে, সে প্রশ্ন রয়েছে। আগের ধারায় নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে যেতে হলে অবশ্য চীন-রাশিয়ার মতো শক্তির দিকে আরও বেশি করে ঝুঁকতে হবে সরকারকে। রাজনৈতিকভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন না হলেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পশ্চিমা সহায়তা হারানোটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। শাসকরা কোনোমতে ‘অ্যাফোর্ড’ করতে পারলেও ইতোমধ্যে সংকটে পড়ে যাওয়া সাধারণ মানুষ তা পারবে বলে মনে হয় না।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
- বিষয় :
- রাজনীতি
- হাসান মামুন