উচ্চারণের বিপরীতে
আইন ও নিয়ম সবই মানুষের প্রয়োজনে

প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৩ | ০৪:০৫
ঘটনাটি পরিচিত। বহুবার জানাশোনায় ক্লিশে, জীর্ণ: গ্রামে, প্রান্তিক মানুষের যৌতুক-সংক্রান্ত মামলা। বিয়ের সাত-আট মাস পর বাপের বাড়ি আসে পাত্রী, দিনকয়েক পর পাত্র এসে তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে, এমনই কথা ছিল; কিন্তু পাত্র আর আসে না। উল্টো তিন লাখ টাকা যৌতুক চায়, না দিলে বউকে সে আর বাড়ি নেবে না, জানিয়ে দেয় শ্বশুরকে। পাত্র আরও দাবি তোলে– মেয়ে কালো। কালো মেয়েকে বিয়ে করে ভুল করেছে সে। এখন তিন লাখ টাকা পেলে সে তাকে ঘরে ফেরত নিতে পারে!
পাত্রীর বয়স কত? ১৮? ১৯? বোরকায় আবৃত মেয়েটির বয়স বোঝা মুশকিল, তার পিতা নূরুল আমার শৈশবের খেলার সাথি, শৈশবে এক দমে আমরা দিগন্ত ছুঁতে চেয়েছি– এখন আমাদের দু’জনেরই বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে, ময়মনসিংহের নিভৃত গ্রাম থেকে সে কন্যাকে নিয়ে রাজধানী আসে। কন্যাকে নূরুল জানিয়েছে, ঢাকায় তাদের হয়ে মামলা লড়বার মতো ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিক আছে তার। আপিস-দপ্তরে পিতা-কন্যার মুখোমুখি বসে পরিচিত ঘটনা আমার সামনে অপরিচিত হয়ে ধরা দেয়।
মুখের নেকাব খুলে মেয়েটি, যার নাম তামান্না, সে একতাড়া কাগজ আমার হাতে তুলে দেয়। বড় যত্ন করে বয়ে আনা মামলার নথিপত্র। বাদিহাটি গ্রামের প্রান্তিক কৃষক নূরুল ইসলাম এককালে সামান্য অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ছিল, কিন্তু চার দশকের অব্যবহারে তার সেই জ্ঞান এরই মধ্যে লুপ্ত, ইংরেজি দূরে থাক– বাংলা অক্ষরই সে আর আজ পড়ে উঠতে পারে না। তামান্না মাদ্রাসায় দুই-তিন ক্লাস পড়েছে, তারও ইংরেজি জ্ঞান শূন্য, বাংলাও তা-ই। চোখেমুখে আত্মবিশ্বাসী মেয়েটি; কাগজের পর কাগজ মেলে ধরে সে বলতে থাকে; বুঝতে পারি, কাগজের লেখাপত্র পড়তে না পারলেও উকিলের কাছ থেকে বারবার শুনে শুনে মামলা সম্পর্কে সে বিস্তারিত জানে। যৌতুক না পেয়ে তামান্নাকে স্বামী তাহের তালাক দেয়।
২০২২ সালের ঘটনা। তামান্না ময়মনসিংহ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে প্রাক্তন স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ সালের ৩ ধারার মামলা দায়ের করে। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট মামলার রায়ে আসামিকে সাজা দেন, তাহেরের দুই বছরের জেল হয়। আসামি সারেন্ডার করে, দুই মাস জেল খাটবার পর জামিনে মুক্ত হয়ে সাজা মওকুফের জন্য জেলা জজকোর্টে আপিল করে। ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ আসামির সাজা বহাল রাখেন। আসামি তাহের এই দফায় আবারও দেড় মাসের মতো জেল খাটে ও আবার জামিনে মুক্ত হয়ে হাইকোর্টে রিভিশন মামলা করে।
তাহের দাবি করে– ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট যে সাজা দিয়েছেন, জজকোর্ট যে সাজা বহাল রেখেছেন, তা অন্যায়। তাই এই রিভিশন মামলা। আসামিপক্ষ হাইকোর্টে তাদের উকিল ঠিক করে, তামান্নার মামলাটি হাইকোর্টে রাষ্ট্রপক্ষের মামলায় পরিণত হয়, রাষ্ট্রের দু’জন অ্যাটর্নি জেনারেলের যে কোনো একজন তামান্নার হয়ে এই মামলা লড়বেন। এসবই তামান্না তার উকিলের কাছ থেকে জেনে প্রায় মুখস্থ করে এসেছে।
তামান্না কম্পিত কণ্ঠে বলে, ‘আমরা ঢাকা শহরে এর আগে আসি নাই। হাইকোর্টের কিছু চিনি না। এতবড় শহরে উকিল সাবদের কই বিচড়ায়া [খুঁজে] পাব! তাই আপনার কাছে আসছি, আপনি আমাদের এই দুই উকিলের যে কোনো একজনরে বিচড়ায়া দিবাইন [দিবেন]!’
২.
তামান্নার মেলে ধরা কাগজ মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকি: ‘Let the records be called for and a Rule be issued calling upon the opposite parties to show cause as to why the judgment and order dated 15.06.2023 passed by the learned Senior Sessions Judge …’
বাংলা অক্ষরজ্ঞানহীন পিতা ও কন্যার হাতে এ ধরনের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ইংরেজিতে লেখা মামলার নথিপত্র, আর সেই নথিপত্র হাতে তারা প্রথমবারের মতো রাজধানী ঢাকা শহরে। উদ্দেশ্য– যে অন্যায় কন্যার জীবনে ঘটেছে, তার চূড়ান্ত প্রতিকার চাওয়া। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট আর জজকোর্টে যে মামলার সাজা হয়েছে, সেই সাজা যেন বহাল থাকে।
পিতা-কন্যাকে আশ্বস্ত করি, তাদের এভাবে উকিল খুঁজে বেড়ানোর দরকার নাই। রাষ্ট্র এখন তার পক্ষ হয়ে এই মামলা লড়বে, এটিই আইন। বলি বটে, তবে একটি প্রশ্ন বারবার সামনে এসে দাঁড়ায়– এইসব মানুষের জীবন সহজ করবার জন্য রাষ্ট্র এই মামলাগুলোকে আরও ‘কাছের’ করে তুলতে পারে না? কাগজপত্রগুলো? ইংরেজিতেই হতে হবে, আজও!
এই পিতা-কন্যার আত্মসম্মানবোধ প্রখর, বখাটে তাহেরের দুই বছরের জেল চূড়ান্ত করবার জন্য তারা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট, জজকোর্ট পেরিয়ে হাইকোর্টে হাজিরা দিতে প্রস্তুত। আসামির দুই বছরের জেল চূড়ান্ত করতে তারা প্রয়োজনে কয়েক বছর মামলা লড়বে, সম্ভবত এ রকম পণও করেছে। গ্রামীণ পিতা ও কন্যার হাতে এত ভারী ইংরেজিতে লেখা মামলার নথিপত্রের স্তূপ আর তাদের সামনে অপরিচিত রাজধানী শহর ও অনিশ্চিত জনপদ আশ্চর্য সব উদ্বেগ ও বিষণ্নতা তৈরি করে! গ্রামে আজও এ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ, তাদের মামলাকে কাছের দূরত্বে চূড়ান্ত ফয়সালা করবার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষত নারীদের মামলা। জীবন ও জীবিকার প্রতি পদে যে নিপীড়ন, নির্যাতন ও প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় নারীদের, মামলা করবার পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা সহজ করে প্রান্তিক পর্যায়েই এসব মামলার চূড়ান্ত বিহিতের ব্যবস্থা করতে পারলে, তা তাদের বেঁচে থাকাকে সহজতর করবে। আইন ও নিয়ম সবই মানুষের প্রয়োজনে। মানুষকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে তাই সবার আগে।
৩.
রাজধানী ঢাকার ৫০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ অফিস-আদালতের প্রধান কার্যালয়। এগুলোর কিছু শহরের বাইরে ছড়িয়ে দিলে ঢাকার অবয়বে ইতিবাচক বদল ঘটবে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির শহর এখন ঢাকা। ১৫২টি দেশের ১ হাজার ২০০টির বেশি শহরে যান চলাচলের গতি বিশ্লেষণে এই চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণাটির ওপর ভিত্তি করে বিখ্যাত সাময়িকী টাইম বৃহস্পতিবার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতি ও দ্রুতগতির দুই শহরের যাতায়াতে সময়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৯ মাইল দূরে গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্কে গাড়িতে যেতে সময় লাগে ৫৫ মিনিট। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ফ্লিন্ট শহরে একই দূরত্বে যেতে সময় লাগে ৯ মিনিট। দুই কোটি মানুষের শহর ঢাকা আর চার লাখ মানুষের শহর ফ্লিন্টে যাতায়াতে সময়ের এই ব্যবধান শুধু গাড়ির চাপের কারণে নয়, আরও কারণ রয়েছে। সেসব কারণের মধ্যে অন্যতম– কম স্থানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর ও স্থাপনা এবং এসবের ফলে কাজের উদ্দেশ্যে বিপুল মানুষের আনাগোনা। তাই গুরুত্বপূর্ণ বহু অফিস ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলে শহর ঢাকা নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ পাবে।
একদিকে মানিকগঞ্জ পেরিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা, অন্যদিকে গাজীপুর পেরিয়ে সুবিস্তীর্ণ এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা ছড়িয়ে দেওয়া যায়। যত বেশি মানুষ ও যানবাহন ঢাকার কেন্দ্র থেকে সরে যেতে থাকবে, স্থবির ঢাকা ততবেশি গতিশীল হবে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাস্তায় চলাচলের গতি ১ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়াতে পারলে দেশে জিডিপি ১০ শতাংশ বাড়বে।
এবং তামান্নাদের জন্য শিক্ষার আলো
মেয়েটি কালো, তাই তার বিয়ের জন্য পিতাকে তিন লাখ টাকা দিতে হবে! এই অন্যায় মানেনি তামান্না, ছুটে গিয়েছে আদালতে; দুই স্তর আদালতে লড়ে, জিতে এসেছে অচেনা রাজধানীতে। প্রখর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এসব মেয়ে যথার্থ শিক্ষার সুযোগ পেলে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারত? গ্রাম পর্যায়ে নারীর যথার্থ শিক্ষা ও কর্মসংস্থান অগ্রাধিকারের সঙ্গে বিবেচনা করা তাই বিশেষ প্রয়োজন।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com