প্রতিবেশী
একজন তাজির উদ্দিন এবং ভারতের ভিসা জটিলতা

আকম সাইফুল ইসলাম
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০
সিলেটের একজন তরুণ তাজির উদ্দিন উচ্চশিক্ষার্থে চেক রিপাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। তাঁর ভিসার জন্য দূতাবাসে সাক্ষাৎকারের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ২৪ অক্টোবর। হিসাবমতে তাঁর হাতে আছে অফুরন্ত সময়। তবে সমস্যা একটাই। চেক রিপাবলিকের ভিসার জন্য তাজির উদ্দিনকে হাজির হতে হবে দিল্লিতে চেক রিপাবলিক দূতাবাসে। চেক রিপাবলিকসহ পৃথিবীর অনেক দেশেরই দূতাবাস বাংলাদেশে থাকলেও এখানে ভিসা অফিস নেই। তাই সেসব দেশের ভিসার জন্য বাংলাদেশিদের যেতে হয় দিল্লি বা সিঙ্গাপুরে। তাজির উদ্দিনকে যেতে হবে দিল্লি। নিয়মানুযায়ী তাঁর লাগবে ভারতের ডাবল এন্ট্রি ভিসা।
শুধু উচ্চশিক্ষা নয়, ওই দেশগুলোতে কাজ বা ব্যবসার জন্য যেতে হলেও বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসার জন্য দিল্লি বা অন্য দেশে অবস্থিত দূতাবাসে যেতে হয়। ভারতীয় ভিসাপ্রাপ্তির বিলম্বজনিত কারণে তাই কর্মসংস্থান, ব্যবসা প্রভৃতি ঝুঁকির মুখে পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের অগ্রগতি।
ভারতীয় ভিসা প্রদানে বিলম্ব, জটিলতা বা কঠোরতা; যা-ই বলি না কেন, তার চাপ কিন্তু ভারতেও পড়ছে। কলকাতাকেন্দ্রিক সংবাদপত্রগুলো ইতোমধ্যে কলকাতা নিউমার্কেটের ব্যবসায় ধস নামা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। কলকাতাগামী পরিবহনের যাত্রী কমে গেছে। সম্প্রতি চেন্নাই অ্যাপোলো হাসপাতালে গিয়ে দেখেছি, বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে।
এতে অবশ্য এমনটা ভাবার সুযোগ নেই, বাংলাদেশের হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বরং ভারতগামী মানুষের একটা অংশ চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরমুখী হবে; আরেকটা অংশ বিনা চিকিৎসা বা অপচিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরবে। করোনা আতঙ্কের পর থেকে ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলোয় উপচে পড়া ভিড় পরিলক্ষিত হতে থাকে। এই ভিড়ে ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলোয় বেসামাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই বেসামাল অবস্থা রোধ করতে গত ১০ জুলাই ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রগুলো অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রথা চালু করেছে। এই প্রথা হচ্ছে, অনলাইনে আবেদন তৈরির পর অনলাইনে ভিসা প্রসেসিং ফি ৮০০ টাকা, টাকা প্রেরণ খরচ ২৪ টাকাসহ ৮২৪ টাকা পাঠালে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যাবে। সেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট তারিখ ও সময়ে মূল আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। কোনো কারণে নির্দিষ্ট সময়ে আবেদনপত্র জমা দিতে ব্যর্থ হলে আবেদন ফরমটি বাতিল হয়ে যাবে এবং নতুন করে শুরু করতে হবে। মাত্র জুলাইয়ের ১০ তারিখে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেম চালু হলেও এখনই ট্যুরিস্ট ভিসার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগছে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ভিসা আবেদনকেন্দ্রে ভিড়টাই দেখল; ভিড়ের কারণ দেখল না। করোনার আগে যেখানে ট্যুরিস্ট ক্যাটেগরিতে ৬৫ বছরের কম বয়সীরা এক বছর মেয়াদে এবং তদূর্ধ্বরা ৫ বছর মেয়াদে মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা পেতেন। সেখানে করোনার পর ভিসার মেয়াদ গণহারে ৩ মাস, ক্ষেত্রবিশেষে ৬ মাস ও সিঙ্গেল এন্ট্রি দেওয়ায় ভারতমুখী মানুষকে ঘন ঘন ভিসার আবেদন করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে ১৬টি ভিসা আবেদনকেন্দ্র আছে। গড়পড়তা বৃহত্তর ১৯ জেলায় একটা করেও পড়ে না। উপরন্তু বৃহত্তর জেলা ফরিদপুর, জামালপুর, পটুয়াখালী এবং টাঙ্গাইল ও রাঙামাটিতে কোনো ভিসা আবেদনকেন্দ্র নেই। দেশের প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষের বসবাসের শহর ঢাকা হলেও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ জেলার মানুষকে ভিসার জন্য ঢাকা কেন্দ্রেই আবেদন করতে হয়। ফলে দেশের বাকি ১৫টি কেন্দ্রের তুলনায় ঢাকায় ভিড় স্বাভাবিক কারণেই বেশি। করোনার আগে ভিসা আবেদনকেন্দ্র শুধু শুক্রবার বন্ধ থাকলেও করোনার পরে শুক্র ও শনিবার দু’দিন বন্ধ থাকে, যা কেন্দ্রের ভিড় ২০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।
ভারত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রতিবেশী। এ দেশের তিন দিকের প্রায় পুরোটাই ভারতের ভূমি। ঐতিহাসিকভাবে দু’দেশের সম্পর্ক নিবিড় না হয়ে তাই উপায় নেই। একই কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসাসহ যে কোনো বিষয়ে প্রথমেই আমাদেরকে ভারতের দ্বারস্থ হতে হয়। দু’দেশের মধ্যে তাই সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। তৃতীয় দেশে উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সহায়তার জন্যও ভারতের সহযোগিতার বিকল্প নেই। সবকিছু মিলিয়ে ভারতীয় ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে সব ধরনের জটিলতা পরিহার করা সময়ের দাবি। ভিসাপ্রাপ্তি সহজতর হলে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি ভারতীয়রাও লাভবান হবে। ভারতীয় ভিসা প্রদান সহজতর করতে যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া যেতে পারে: ১. অ্যাপয়েন্টমেন্ট প্রথা বাতিল; ২. বয়স নির্বিশেষে সব ট্যুরিস্ট ভিসা পাসপোর্টের মেয়াদ পর্যন্ত বা পাঁচ বছর মেয়াদি মাল্টিপল এন্ট্রি প্রদান; ৩. শনিবার ভিসা অফিস খোলা রাখা এবং ৪. ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, জামালপুর, পটুয়াখালী ও রাঙামাটিতে ভিসা আবেদনকেন্দ্র স্থাপন।
তাজির উদ্দিন ভিসা না পেলে শুধু তাঁর নয়, বিপন্ন হবে আমাদের অনেকেরই ভবিষ্যৎ। কারণ তা উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ থেকে নতুন প্রজন্মকে বঞ্চিত করবে; দেশকে যার নেতিবাচক প্রভাব বইতে হবে দশকের পর দশক। তাজির উদ্দিনরা যাতে সহজেই তৃতীয় দেশের ভিসার জন্য সাক্ষাৎকারে উপস্থিত থাকতে প্রয়োজনীয় ভারতীয় ভিসা দ্রুত পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাই আমাদেরও। সবাইকে এ নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। ভারতীয় ভিসা সহজলভ্য করতে উভয় দেশের সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে– আমরা এই আশায় দিন গুনি। আকম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব