ঢাকা বৃহস্পতিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৩

দশদিক

বিএনপি কি পানি মাপতে ভুল করছে

বিএনপি কি পানি মাপতে ভুল করছে

ফারুক ওয়াসিফ

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২৩ | ১২:০৩

227.997x400 আগে জনগণ সরকার বদলাত, এখন সরকারই জনগণকে বদলে দেয়। শুধু জনগণ কেন, বাংলাদেশে সরকার ছলে ও বলে বিরোধী দলের আচরণকেও বদলে দিচ্ছে। বিএনপি সমাবেশের নজির সৃষ্টি করে। সরকার ভেন্যু বদলে দিয়ে সেটাকে ব্যর্থতার নজিরে পরিণত করে। বিএনপির আলটিমেটামগুলো হয়ে যায় কথার কথা, কাজের কথা না। সর্বশেষ খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে তৈরি করা নাটকে ঢুকে স্বেচ্ছায় ধোঁকা খেল বিএনপি।

বিএনপিকে হয়তো বলা হয়েছিল, আগে যা হয়েছে হোক, এই দফায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো যেতে পারে– আপনারা আবেদন করুন। এই আবেদন-নিবেদনেই চলে গেল সেপ্টেম্বর মাসের গুরুত্বপূর্ণ শেষ পনেরো দিন। মিডিয়ার শিরোনাম আর বিএনপির আন্দোলন ভিন্ন খাতে বয়ে গেল।

রাজনীতি কূটকৌশলের জায়গা। যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে বিন্দুমাত্র আস্থা ও শ্রদ্ধা নাই, সেখানে নীতিহীন কৌশল নিতেও কেউ পিছপা হয় না। আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে ওস্তাদ। সব জেনেও বিএনপি জেনেশুনে ঠকল কেন? কী করে তারা বিশ্বাস করে, তাদের নেত্রীকে এই সরকার বিশেষ সুবিধা দিয়ে বিদেশে চিকিৎসা করতে পাঠাবে? বন্দি খালেদা জিয়া হলো আওয়ামী লীগের রাজনীতির ট্রফি, বন্দি অবস্থায় তিনি এক প্রকার জিম্মি। এখন কেউ কি শত্রুপক্ষ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া ট্রফি বা জিম্মিকে বিনা প্রতিদানে ফেরত দেয় বা দেবে? দেবে না। খালেদা জিয়া যখন চরম অসহায় ও মারাত্মক অসুস্থ দশায়ও আপসহীনতার কথা বলেন, সরকারও তখন আপসের সম্ভাবনা বাতিল করে দেয়। তাহলে কেন এ সময়টা খোয়াল বিএনপি? এটি তাদের কৌশলগত ভুল।

২০১৪ সালেও এই ভুল করা হয়েছিল। ২০০১-০৬ মেয়াদেও তারা ভুল করেছিল। সেটা ওয়ার অন টেররের তুমুল সময়। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সেই যুদ্ধের পার্টনার। সেরকম একটা সময়ে ভারতের গা ঘেঁষে বিএনপি-জামায়াতের সরকার কী করে চলতে পারে? কীভাবে পুনর্নির্বাচিত হতে পারে? ২০১৪-তেও তাদের কৌশলী হওয়া দরকার ছিল। দেশে-বিদেশে মিত্রহীন অবস্থায় কেউ গণঅভ্যুত্থান করতে পারে না। বলা হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি এসেছে আসন বণ্টনের আশ্বাস থেকে। এই দাবি সত্যি হলে বলতে হয়, বিএনপি আশ্বাসে বিশ্বাস করে সর্বস্ব খুইয়েছিল। এইবার তারা কীসের আশায় আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে? কী ঘটনার আশা করছে এই অক্টোবরে?

ঠিক, বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ভর করছে অক্টোবর মাসের ঘটনাবলির ওপর। আইরিশ কবি টি এস এলিয়ট তাঁর বিখ্যাত ‘ওয়েস্টল্যান্ড’ বা ‘বিরানভূমি’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘নিষ্ঠুরতম মাস এই এপ্রিল’। বাংলাদেশ তো আশাবাদের বিরানভূমি। সেই বিরানভূমিতে ‘নিষ্ঠুরতম মাস এই অক্টোবর’। যদি গণআন্দোলন হয় তাহলে রক্তপাতের ভয়। যদি কিছুই না হয় তাহলে নক্ষত্রের চুপসে গিয়ে ব্ল্যাকহোল হওয়ার ভয়। ব্ল্যাকহোল সব শুষে নেয়। ইতোমধ্যে অনেক কিছুই শুষে নেওয়া শুরু হয়েছে। এখন আর ভনিতা করার কোনো সুযোগ নাই। সোজা কথায় বলা যাক। যদি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে ভারসাম্যমূলক সংসদ গঠিত না হয়; যদি বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল সংসদ নির্বাচন বর্জনে বাধ্য হয় বা সুযোগই না পায়; তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় একচেটিয়া কর্তৃত্ববাদ স্থায়ী বনিয়াদ পেয়ে যাবে।

দেশে-বিদেশে অনেক চাপ। অর্থনীতি গলাপানিতে। এই ঘোলাস্রোতে সরকার না হয় তার তরী বেয়ে নিতে পারল; কিন্তু বিএনপি কী করবে? আওয়ামী লীগের মতো ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি থাকেনি সত্য। কিন্তু ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬-এর পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরের অর্ধদশক দলটির জন্য বিভীষিকা ছিল। কিন্তু এরশাদের আমলে অন্তত সামাজিকভাবে টিকে থাকার উপায় ছিল। এরশাদশাহি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করলেও সমাজ ছিল অনেকটা মুক্ত। এরশাদ অন্তত কোনো দলকে একেবারে নির্মূল করবার মিশন নিয়ে নামেননি। কিন্তু গত এক যুগের রাজনৈতিক বাস্তবতা বিএনপির জন্য ডাঙায় তোলা মাছের মতো। আরও একটা সংসদীয় মেয়াদ তাদের পক্ষে এই পরিবেশে টিকে থাকা মারাত্মক কঠিন। যেনতেন টিকে থাকা হবে অর্থহীন।

কিন্তু দলটির মধ্যে টিকে থাকার মরিয়া লড়াই কি দেখা যাচ্ছে? সেপ্টেম্বর মাসের মূল্যবান শেষ দশটি দিন খালেদা জিয়ার চিকিৎসাবিষয়ক সরকারি নাটকে ব্যবহৃত হলো। দ্বিতীয়ত, বিএনপিকে যে কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে হলে আগে আন্দোলনে জিততে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাস বলে, আন্দোলনে বিজয়ী শক্তিই পরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে জয়ীরাই পরে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে বিজয়ী। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী নেতা ছিলেন ভাসানী-মুজিব। ভাসানী ১৯৭০-এর নির্বাচন বর্জন করলে আওয়ামী লীগ একচেটিয়া বিজয় পায়। ১৯৯০-এর আন্দোলনে বিজয়ীদের মধ্যে বেশি নিরাপস ছিল বিএনপি জোট। পরের নির্বানে তাই তারাই সরকার গঠন করেছে এবং দ্বিতীয় বিজয়ী আওয়ামী জোট সংসদে সম্মানজনক আসনে বসতে পেরেছে। ১৯৯৬ সালের আন্দোলনের জয়কে নির্বাচনী জয়ে পরিণত করে আওয়ামী লীগ। ২০০১-এর আন্দোলনে বিজয়ী বিএনপি-জামায়াত সরকার গঠন করে। একইভাবে ২০১৪ ও ২০১৮-তে আন্দোলনে পরাজিত বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া না-যাওয়া আর কোনো বিষয় হতে পারে নাই। কিন্তু এবার কী হবে?

অক্টোবরে হোক নভেম্বরে হোক, আন্দোলনে দাবি আদায় করতে না পারলে বিএনপি নির্বাচনে গেলেও ঠকবে, না গেলেও ঠকবে। মার্কিন ভিসা নীতি সব করে দেবে না। বিএনপিকে দেশের ভেতরের কাঠামোগত শক্তিগুলোকে হয় নিরপেক্ষ নয়তো পক্ষে টানতে পারতে হবে। সর্বোপরি জনগণকে রাস্তায় নামাতেই হবে এবং টানা অবস্থান ধরে রাখতে হবে। আন্দোলন লেফট-রাইট পিটি করা নয়, আন্দোলন আদালতের এজলাসও নয়। আন্দোলনে জিততে হলে জেল বা মৃত্যুর ঝুঁকি নিতেই হয়।

যারা প্রমাণ করতে পারে যে জনজীবনের লাগাম আমার হাতে– তারাই জয়ী হয়। সবকিছু তখন তাদের পক্ষে চলে আসে। সেই কাজটা কি বিএনপি করতে পারবে? কিংবা একাই করতে পারবে?

যদি না পারে, তাহলে পশ্চিমা আশ্বাস কিংবা পেছন দরজায় বিশ্বাসে তাদের লাভের সম্ভাবনা বেজায় কম। তাহলে কীসের তরে দিন গুনছে বিএনপি? তারা কি কোনো অগণতান্ত্রিক পন্থার ভরসা পেয়েছে? অগণতান্ত্রিক পন্থার সুফল পাবার সুযোগও তাদের কম। অঙ্ক বলে, আন্দোলনে জয়ী না হলে কোনো পন্থারই সুফল পাওয়ার উপায় বিএনপির নাই। ক্যালকুলাস গণিতের জটিল শাখা। সেই গণিতের অঙ্কে ফল মেলাতে হলে একটা অজানা রাশি ‘এক্স’ ধরে নিতে হয়। সেই অজানা রাশির মান জানার পর অঙ্কটা মেলানো যায়। একে বলে ‘এক্স ফ্যাক্টর’। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এমন ‘এক্স’ মাত্রার ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। কোনো দৈবদুর্বিপাক, ভয়ংকর কোনো পরিণতি কিংবা আকস্মিক কোনো জাগরণ হলো সেই ‘এক্স’ রাশি। রাজনীতির অঙ্কে অবশ্যই এক্স ফ্যাক্টরকে হিসাবে নিতে হবে। কিন্তু সেই অজানা রাশির ওপর নিশ্চয়ই বাজি ধরা যায় না। ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সমকালের পরিকল্পনা সম্পাদক farukwasif0@gmail.com

আরও পড়ুন