ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

গৃহকর্মীদের মর্যাদা

আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত হোক

আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত হোক

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২০ | ১২:০০

গৃহশ্রমিক কিংবা কর্মীদের ওপর নানারকম নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা দেশে ইতোমধ্যে কম ঘটেনি। দেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে- এই খবর আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। শুক্রবার সমকালের একটি প্রতিবেদনে সমকাল-সুনীতি অনলাইন গোলটেবিল সেমিনারের উঠে আসা চিত্র সাক্ষ্য দেয়- সমাজের অনেককেই এখনও মানবিকতা স্পর্শ করেনি। আমরা জানি, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে জাতীয় দলের ক্রিকেটারের পরিবারে পর্যন্ত গৃহকর্মী নির্যাতনের কদর্যতার অনেক চিত্রই সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। তাতে প্রতীয়মান হয়, সমাজের অনেকাংশেই এখনও প্রদীপের নিচের মতো অন্ধকার ছড়িয়ে আছে। এ-সংক্রান্ত নীতিমালা আছে বটে; কিন্তু সরকারি পর্যবেক্ষণ ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে বন্ধ হচ্ছে না অমানবিকতা।
করোনা-দুর্যোগ দেশে নানামুখী সংকটের সৃষ্টি করেছে। এর সঙ্গে গৃহকর্মীরা পড়েছেন নতুন সংকটে। তাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রই শুধু সংকুচিত হয়নি বিদ্যমান কঠিন বাস্তবতায় তাদের আরও কিছু প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত তাদের পেশা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পাওয়ায় এই পরিস্থিতি তাদের সামনে প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর আরও উঁচু করেছে। প্রশিক্ষণ ও আইনি স্বীকৃতির মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থান-সামাজিক মর্যাদা-সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ ইতোপূর্বে নানা মহল থেকে দেওয়া হলেও সমাজে আজও এর ইতিবাচক প্রতিফলন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবস উপলক্ষে সুনীতি প্রকল্পের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার অনলাইন সেমিনারে যেসব মতামত উপস্থাপিত হয়েছে, সেসব আমলে নিয়ে নীতিমালা বাস্তবায়নে সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, বিষয়টি শুধু মানবিকতার নয়, আইনি ব্যাপারও বটে।
আমরা জানি, বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল পরিবারগুলোর দৈনন্দিন জীবনে নানাবিধ প্রয়োজনেই গৃহকর্মী প্রয়োজন হয়। এ পরিপ্রক্ষিতে গৃহকর্মীদের প্রতি সুবিচারের বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয় না। আমরা এও জানি, কোনো কোনো গৃহকর্তা কিংবা কর্ত্রী শুধু নিপীড়ন-নির্যাতন করেই ক্ষান্ত নন, কেউ কেউ হত্যাকাণ্ডের মতো নির্মম-নিষ্ঠুর দৃষ্টান্তও সৃষ্টি করেছেন। পাশাপাশি বহু ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে যৌন নিপীড়নেরও। আবার অনেকে নির্যাতন সইতে না পেরে বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান এমন সব কদর্যতা ধামাচাপা পড়ে যায় প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে।
আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই এসব নিপীড়ন-নির্যাতনের মামলা হলেও বিচার হয় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবশালী মহলের চাপের মুখে সমঝোতা কিংবা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলাগুলো আর কার্যকর থাকে না। এর নিরসন ঘটাতে হবে। মামলা সাজানোর ক্ষেত্রে যদি ত্রুটি থাকে কিংবা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাব থাকে, তাহলে সুবিচার আশা করা দুরাশারই নামান্তর। ২০১৮ সালে এ-সংক্রান্ত আইনের সংশোধনীতে গৃহকর্মীকে শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করা হলেও গৃহকর্মকে শ্রমের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। বিদ্যমান বাস্তবতার নিরিখে গৃহকর্মীর শ্রমকে স্বীকৃতি দিলে নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিকার পাওয়ার পথটা হয়তো মসৃণ হতো। শুভবোধসম্পন্ন মানুষ নিশ্চয়ই চান, গৃহকর্মীরাও মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ- এটুকুর স্বীকৃতি নিশ্চিত হোক।
আইএলও কনভেনশনে সরকার আইএলসিতে ভোট দিয়েছে এবং এর আলোকে নীতিমালাও তৈরি করেছে। কিন্তু নীতিমালা প্রণয়নই শেষ কথা নয়, প্রয়োজন এর যথাযথ বাস্তবায়ন। এর আলোকে যদি আইনে আরও সংশোধনী আনা প্রয়োজন হয়, তবে তাও গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রণীত নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্নিষ্ট সব মহলের কর্মতৎপরতা জরুরি। করোনা-দুর্যোগে সিংহভাগ গৃহকর্মী কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তাদের অনেকে খণ্ডকালীন কাজও করতেন। এখন তাও বন্ধ হয়ে গেছে। এই বাস্তবতা ও তাদের নিরাপত্তা মর্যাদাসহ সার্বিক জীবন-জীবিকার বিষয়টি সেই নিরিখেই বিবেচনায় নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়িয়ে তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে। দেশে গৃহকর্মী কিংবা গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্ত ৮০ ভাগের ওপরে রয়েছেন নারী, যাদের মধ্যে আবার শিশু ও তরুণীর সংখ্যাই বেশি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়ে দ্রুত আরও গভীরভাবে ভেবে তাদের নিরাপত্তাসহ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মানবিক সব অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
তাদের আইনি সুরক্ষার ব্যাপারে কোনো রকম উদাসীনতা ও কালক্ষেপণ কাম্য নয়। গৃহকর্মী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নীতিমালায় উল্লিখিত শর্তগুলো বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হোক। গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা শুধু মানবিক দায়ই নয়, আইনি দায়ও বটে। তাদের কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করা, মজুরি নির্দিষ্ট করা, নিয়োগপত্র প্রদান- এসব বিষয়েও সমভাবেই গুরুত্ব দিতে হবে। করোনা-দুর্যোগ হয়তো একসময় কেটে যাবে; কিন্তু গৃহশ্রমিকদের জীবনের অন্ধকার কবে দূর হবে তা যেন উত্তরহীন প্রশ্ন হয়ে না থাকে।
whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×