ঢাকা শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

সাহেদ-সাবরিনার 'নির্মাতারা' কোথায়!

সাহেদ-সাবরিনার 'নির্মাতারা' কোথায়!

কাবেরী গায়েন

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২০ | ১২:০০

সংবাদমাধ্যম ও সামজিক মাধ্যমে একের পর এক লোমহর্ষক কাহিনী বের হয়ে আসছে জালিয়াতি এবং দুর্নীতির। এই মহূর্তের সকল আকর্ষণ জেকেজি-রিজেন্ট, সাহেদ-সাবরিনা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজি-স্বাস্থ্যমন্ত্রী। খবরগুলোও তেমন। কেউ অতিমারির ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তো কেউ ১৫ হাজার ভুয়া রিপোর্ট তৈরির অভিযোগে অভিযুক্ত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি বলেন সাহেদকে তিনি চেনেন না, পরদিন দেখা যাচ্ছে রিজেন্ট-এর সঙ্গে চুক্তি করার ছবি। ডা. সাবরিনা বলে দিচ্ছেন কে কে জানেন তাদের রিপোর্ট জালিয়াতির খবর। সঙ্গে আছে রঙিন ছবি। সব মিলিয়ে দুর্নীতি ও জালিয়াতি শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে। এক তামিল অ্যাকশন চলচ্চিত্র ছাড়া কে কোথায় ভাবতে পেরেছেন যে, এক হাসপাতাল থেকে গাড়ি ভাড়া করা হয় পথচারীদের চাপা দিয়ে আহত করে হাসপাতালের সিইউতে এনে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব? সেই ব্যক্তিই টেলিভিশনের টকশোতে এসে দেশ-জাতিকে সবক দেন?
আমাদের দেশে সাহেদ-সাবরিনাদের উত্থান ঘটছে জালিয়াতির মাধ্যমে। আমরা অবাক হয়ে যাই সাহেদের মতো একজন প্রতারক কীভাবে দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী, সংবাদমাধ্যমসহ সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছায়! জালিয়াতিমূলক কর্মকাণ্ডের দায়ে যাদের কারাগারে থাকার কথা, তাদেরকে আমরা দেখতে পাচ্ছি সংবাদমাধ্যমে দেশ ও জাতির উদ্দেশে সবক দিতে। প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমগুলো কি শাহেদের উত্থান সম্বন্ধে কিছুই জানত না? সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কি তাদের জালিয়াতি সম্বন্ধে জানতেন না? এর আগেও আমরা জি কে শামীম, পাপিয়া, সম্রাটসহ বেশ কয়েকজনের ব্যাপারে জেনেছি। তারপরে কী হলো, এ বিষয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট তো দূরে থাক, ফলোআপ প্রতিবেদনও নেই। ডা. সাবরিনা আগে আটক হয়েছেন, বুধবার ধরা পড়েছেন সাহেদ। এই দুর্নীতিবাজদের নিয়ে রিপোর্টিংগুলো খেয়াল করলেই দেখা যাবে এসব অপরাধীর অপরাধের গুরুত্বের চেয়ে অপরাধের অভিনবত্ব নিয়ে সকল আয়োজন এবং সেইদিকে মনোযোগ নির্মাণের মধ্য দিয়ে কয়েকদিনের হৈচৈ শেষে ঘটনাটি জনদৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। ভাববার অবকাশ নেই, এটা এমনি এমনি হয়। আমি বরং বলতে চাই, দুর্নীতির কুশীলবরা ধরা পড়লে দুর্নীতির নির্মাতারা এইসব দৃশ্য তৈরি করেন জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার জন্য।
যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের বিচার কতদূর হবে বলা মুশকিল। মূলত বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয় না থাকায় এই ধারার জালিয়াতদের উত্থান ঘটেছে দেশের কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত। ডা. সাবরিনা জালিয়াতি করে ১৫ হাজার রিপোর্ট দিয়েছেন। তাদের এই অন্যায়ের প্রভাব বহুমুখী। ক্রান্তিকালীন সময়ে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে এই জালিয়াতির প্রভাব দেশ, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ছাপিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বিপন্ন করেছে পৃথিবীর কাছে। ইতোমধ্যে ইতালিসহ কয়েকটি দেশে বন্ধ হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের প্রবেশাধিকার। এই প্রবেশাধিকারের সঙ্গে মানুষের জীবিকার প্রশ্নও জড়িত। একেবারেই অর্থের লোভে মানুষের জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে তারা কভিডের মতো বিষয়ে ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে। কোনো সিস্টেমের কতটা অধঃপতন হলে মানুষের দ্বারা এ ধরনের জালিয়াতি করা সম্ভব হয়ে ওঠে, ভাবাও কষ্টসাধ্য। অথচ আমাদের দেশের গণমাধ্যম সাহেদকে প্রতিষ্ঠিত করেছে একজন জনদরদী ব্যক্তি হিসেবে। তার হাসপাতালের লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও করোনা চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্তারা এই দুর্নীতির দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। আমরা দেখেছি, কয়েকজন মানুষকে এ ধরনের অভিযোগে আগেও জেলে নেওয়া হয়েছে কিন্তু দুর্নীতি কমেনি। কমানো সম্ভব নয়। যে সিস্টেমের বলে তাদের উত্থান ঘটেছে সেখানে হস্তক্ষেপ করা না গেলে পাপিয়া-সাহেদ-সাবরিনারা আসতেই থাকবেন।
সাহেদ-সাবরিনা-আরিফ সরাসরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে কাজ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের সরাসরি আওতাভুক্ত। যেভাবে লাইসেন্সবিহীন হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, শুধু এই অভিযোগেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজি এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ হতো যে কোনো যৌক্তিক দেশে। যখনই কেউ আটক হন দুর্নীতির অভিযোগে, তখন সংশ্নিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা এমন ভান করেন, যেন তারা কিছুই জানেন না। অথচ এগুলোর পেছনে সরকারি দলের প্রত্যক্ষ মদদ যেমনি থাকে তেমনি মন্ত্রী বা মহাপরিচালক পর্যায় থেকেও পৃষ্ঠপোষকতা থাকে।
ডা. সাবরিনা একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ভুয়া রিপোর্টের বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি জানতেন। এ রকম অভিযোগের পরও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি এখনও বহাল তবিয়তে আছেন। সাহেদ, ডা. সাবরিনা, তার স্বামী আরিফ যদি হয় পারফরমার দুর্নীতিবাজ, তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যেসব কর্তাব্যক্তির নাম উঠে এসেছে, তারা কি তবে নেপথ্যের পরিচালক? ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন যা আসলে ক্ষমতাসীন দলের নির্দেশের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সংবাদমাধ্যমের কেউ কেউ এই তিনের নেক্সাসই তৈরি করেছে এমন বীভৎস দুর্নীতিবাজদের।
সংবাদমাধ্যমের কথা বলতেই হবে। সাহেদের মতো এক অশিক্ষিত দুর্নীতিবাজকে বসিয়েছে নৈতিক কারবারির অবস্থানে। চ্যানেলের পর চ্যানেলে তিনি টকশো করেছেন। সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ ছবি। সাহেদের উত্থানের পেছনে রাজনৈতিক ক্ষমতাবলয়ের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের কেউ কেউ কম দায়ী নয়। ডা. সাবরিনা অনৈতিক কাজ করেছেন। কিন্তু আমরা দেখছি কিছু সংবাদমাধ্যম তার সৌন্দর্য, পোশাক, ব্যক্তিগত জীবন, চরিত্র ইত্যাদি বিষয় রসালোভাবে উপস্থাপন করছে। অথচ ফোকাস করার কথা ছিল তাদের অপরাধে। মনে করার কারণ নেই, কেবল পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই কাজটি করা হচ্ছে।
আমরা দেখতে চাই সাবরিনা ও সাহেদদের বিচার। দেখতে চাই তাদের পৃষ্ঠপোষক কারা। দেখতে চাই তারা যাদের সাহায্যে নির্ভয়ে এ ধরনের জঘন্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করে যাচ্ছিল তাদের বিচারের আওতায় আনা হয় কিনা। যারা এসব প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দিয়েছেন, তাদেরকে দ্রুত পদচ্যুত করে বিচারের আওতায় আনা জরুরি। সাহেদরা প্রতারক এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে যারা প্রতারণার প্রক্রিয়া তৈরিতে সাহায্য করে এবং সেই প্রক্রিয়া জিইয়ে রাখে, তারা আরও বড় প্রতারক। তারাই দুর্নীতিচক্রের পরিচালক। ফলে পুরো চক্রের বিচার হওয়া দরকার।
জি কে শামীম, সম্রাট, পাপিয়া, সাহেদ ও সাবরিনাদের আগে থেকেই চিনতেন এবং তাদের কর্মকাণ্ডগুলো জানতেন আমাদের রাজনীতি, সরকার ও সংবাদমাধ্যমের অনেকে। গ্রেপ্তার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যত তথ্য আমরা পাই তা আগে থেকে জানা না থাকলে প্রকাশ করা অসম্ভব। সাহেদরা ক্ষমতা ও রাজনীতির সঙ্গে যেন অবিচ্ছেদ্য। একটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যখন ধ্বংস হতে থাকে, তখন সাহেদদের উত্থান অনিবার্য। সাহেদরা তখনই কেবল বিপদে পড়ে যখন তাদেরই ভেতরের কোনো প্রতিপক্ষ তাদের অপরাধের বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসে।
কিছুদিন আগে আমরা একটি শুদ্ধি অভিযান দেখেছি। প্রত্যাশা ছিল সরকার এ ধরনের অভিযান অব্যাহত রাখবে এবং অপরাধ সংগঠনের উপায়-উপকরণগুলো চিহ্নিত করে একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে। কিন্তু তেমনটি হয়নি। মন্ত্রী যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন কিংবা একটি প্রতিষ্ঠানের ডিজি পর্যায়ের কর্তার যদি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে, তবে শুদ্ধি অভিযান কে চালাবেন? স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থ হয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি জলাঞ্জলি দিয়েছেন। সাহেদরা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। সরকারের দায়িত্ব পুরো অপরাধ চক্রকে জাতির সামনে উপস্থাপন করার পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এবং যে প্রক্রিয়ায় এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে তা চিহ্নিত ও মূলোৎপাটন করা। নয়তো দুর্নীতির নির্মাতাচক্র নতুন সাহেদ-সাবরিনা-আরিফ-শামীম-পাপিয়াদের তৈরি করে চলতেই থাকবে।
অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×