ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

রোহিঙ্গা সংকট

প্রত্যাবাসনই বড় চ্যালেঞ্জ

প্রত্যাবাসনই বড় চ্যালেঞ্জ

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২০ | ১৪:২৬

ঠিক তিন বছর আগে, ২০১৭ সালের আজকের দিনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম হত্যা, নির্বিচার ধর্ষণ, ভয়াবহ অগ্নিসংযোগ, অবর্ণনীয় অত্যাচার এবং নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে বাঁচতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে। আহত, গর্ভবতী নারী, হাত কাটা, পা কাটা রক্তাক্ত পুরুষ, ক্লান্ত-অবসন্ন আবাল, ঝুড়িতে ঝুলে ঝুলে আসা বৃদ্ধ, কাঁধে-পিঠে চড়ে আসা হাজার হাজার শিশুর ঢল নামে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্তে। তারা মৃত্যুর মুখ থেকে জানটা নিয়ে কোনো রকমে পালিয়ে এসেছে।

২০১৮ সালের আগস্টে প্রকাশিত জাতিসংঘ গঠিত তিন সদস্যের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের ৪৪৪ পৃষ্ঠার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে শুরু করে দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করে। প্রায় দশ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রায় এক হাজার ৯শ' নারীকে ধর্ষণ করা হয়, যাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দলগত ধর্ষণের শিকার হয়। ৩৯০টি গ্রাম আংশিক বা পুরোপুরি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়াবহতা ও নিষ্ঠুরতা এত তীব্র ছিল যে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার এ ঘটনাকে 'পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারযোগ্য জাতিগত নিধন' আখ্যায়িত করেছিলেন। অনেকে এটাকে আখ্যায়িত করেছেন 'জেনোসাইড' এবং 'মানবতাবিরোধী অপরাধ' হিসেবে। এরপর থেকে বাংলাদেশ ১১ লক্ষাধিক, কারও কারও মতে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি অস্থায়ী ক্যাম্পে রেখে ভরণপোষণ করছে।

তিন বছর ধরে উখিয়া ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে এত বিপুল রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী প্রশংসা অর্জন করেছে। তবে তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা, স্যানিটেশন, সুপেয় পানি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সংস্থার সহযোগিতা নিয়েও বাংলাদেশকে এ বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের প্রকোপ ও প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধেও ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। সংবাদমাধ্যম, মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছিল, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে একবার করোনা সংক্রমণ শুরু হলে সেটা ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নেবে। কিন্তু পরিস্থিতি সেরকম হয়নি। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে মাত্র ৬৫ জন করোনা পজিটিভ। মৃত্যুর সংখ্যা ৬ জন। সরকারের দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সক্রিয় সহযোগিতায় সেখানে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে।

করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে রোহিঙ্গা ইস্যু জনপরিসরে এখন বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হচ্ছে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় একেবারেই মৌলিক প্রয়োজন মেটানো ছাড়া বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলোর কার্যক্রমও সীমিত করা হয়েছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব হয়তো কমে যাবে; কিন্তু চতুর্থ বছরে বিপুল শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন- রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করা, বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর প্রতিদিনকার খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা, শরণার্থী শিবিরসহ উখিয়া-টেকনাফের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্থানীয়দের সঙ্গে অবনতিশীল সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখা এবং রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণে ক্রমহ্রাসমান আন্তর্জাতিক সাহায্যের চ্যানেল অব্যাহত রাখা।

অনস্বীকার্য, চতুর্থ বছরে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু ও ত্বরান্বিত করা। মানবিক কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয় দিয়েছে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেয়নি। সুতরাং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে অগ্রাধিকার হচ্ছে- রোহিঙ্গাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করে এবং ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে। সেই চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম দফা এবং ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করা হলেও উভয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। এ ব্যর্থতার অন্যতম কারণ রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত নিতে মিয়ানমারের অনাগ্রহ, ক্রমাগত অসহযোগিতা, দৃশ্যমান প্রস্তুতিহীনতা এবং মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের বিশ্বাসযোগ্য কোনো আশ্বাস দিতে না পারা।

স্বাভাবিক কারণেই রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরতে রাজি হয়নি। তারা মনে করে রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গাদের জন্য এখনও অনিরাপদ ও ঝঁকিপূর্ণ। তাছাড়া যেসব রোহিঙ্গা (প্রায় ৪/৫ লাখ) রাখাইনে বসবাস করছে তারা এখনও মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছে। এ ছাড়া প্রায় এক লাখ ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইনে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু (আইডিপি) হিসেবে দিনাতিপাত করছে। মিয়ানমার তাদেরই কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত করেনি। তাই তৃতীয় দফা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের একটি যৌথ সভা হওয়ার কথা থাকলেও সেটি পিছিয়ে যায়। পরে করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আর খুব একটা এগোয়নি। মে মাসে একটা যৌথ সভা হওয়ার কথা থাকলেও কোনো পক্ষ থেকেই উদ্যোগ গ্রহণ না করার কারণে আর হয়ে ওঠেনি। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করেই মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল করতে বাধ্য করতে হবে।

পরিশেষে বলব, রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমান্বয়ে নেতিবাচক হয়ে উঠছে, যেটা কাঙ্ক্ষিত নয়। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে স্থানীয় জনগণকে নানা ধরনের কষ্ট স্বীকার করতে হচ্ছে, এটা সত্য ও স্বীকার্য। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা তাদের নিজেদের সৃষ্টি নয়। তারা জীবন বাঁচানোর জন্য বাধ্য হয়ে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। তাই এখানে মিয়ানমারকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। মিয়ানমারকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে; কেননা সমস্যার সমাধান তাদেরই হাতে। রোহিঙ্গারাও নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়। তাই সম্মান, নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকারের সঙ্গে কীভাবে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় দেশে ফিরে যাবে মিয়ানমারকেই তার ব্যবস্থা করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সামনে এসে সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে মিয়ানমারকে বাধ্য করার ব্যবস্থা করতে হবে। এটাই হবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

আমরা চাই, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হোক। মানুষ তার প্রাপ্য অধিকার ফিরে পাক। মানবতার জয় হোক।

অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

আরও পড়ুন

×