মুজিববর্ষ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যালামনাস

মো. আবদুর রহিম
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২০ | ১৪:৩৫
এই জনপদের সবচেয়ে প্রাচীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ বছর ১ জুলাই শতবর্ষে পদার্পণ করল। শতবর্ষী এই প্রতিষ্ঠানটি বহু বিখ্যাত ও সফল ব্যক্তির জন্ম দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজনীতিক, প্রধান বিচারপতি, নোবেল লরিয়েট, বিজ্ঞানী, স্থপতি, চিকিৎসক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, শিল্পী, আমলাসহ সমাজ জীবনের সব ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা অদ্যাবধি নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে সবচেয়ে গৌরবের অধিকারী একটি জাতি রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে সংযুক্ত ছাত্র ছিলেন। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। এখান থেকে তিনি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের মাধ্যমে পূর্ববাংলার অধিবাসীদের মুক্তির আন্দোলন সূচনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে আহূত ধর্মঘটে পিকেটিং করার সময় গ্রেপ্তার হন। এভাবে তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হন। তিনি মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে নেওয়ার অসম্মানজনক কাজটি না করে বরং বাঙালির মুক্তির আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করে বাঙালিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি শিক্ষা সংস্কারে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শিক্ষা কমিশন গঠন, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে তিনি শিকড় থেকে শিখর পর্যন্ত শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী সংস্কারের সূচনা করেন। স্বাধীন জ্ঞানচর্চায় সরকারি হস্তক্ষেপ কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনতে পারে পাকিস্তান শাসনামলে তা তিনি প্রত্যক্ষ করেন। সে কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির ১১ নম্বর আদেশের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। এই আদেশ ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর বলে গণ্য হয় (ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, ক্যালেন্ডার, পার্ট-১, পৃ.১)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগদান করে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করবেন এমন পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা জাতির দুর্ভাগ্য সেই সোনালি আলোর ভোর আর হয়নি। তিনি নেই, কিন্তু তার রেখে যাওয়া শিক্ষাদর্শন আমাদের নৈতিক শক্তির ভিত্তি হিসেবে রয়ে গেছে। ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে সব অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রুখে দাঁড়িয়েছে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩'-এর চেতনাকে ধারণ করেই।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক এক নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় সন্তান শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছোট সন্তান শেখ রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। এ ছাড়া তার বড় জামাতা প্রয়াত ড. ওয়াজেদ মিয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ এবং ছোট জামাতা অধ্যাপক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের কৃতী শিক্ষার্থী ও প্রথিতযশা শিক্ষক ছিলেন। পুত্রবধূ সুলতানা কামালও এখানকার কৃতী শিক্ষার্থী ও অ্যাথলেট ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ জাতিকে আত্মদর্শন দিয়েছে আর বঙ্গবন্ধু দিয়েছেন মুক্তি। দুই মহান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষ আরও অর্থবহ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বছরব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শনকে কেন্দ্র করে প্রথমবারের মতো একটি আন্তর্জাতিক মানের রিসার্চ সেন্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও মুজিববর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ ডিগ্রি প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ সেন্টার ফর পিচ অ্যান্ড লিবার্টি' গবেষণা কেন্দ্রের ধারণা একটি ভিন্নমাত্রার চিন্তা ও দর্শন থেকে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনে উপাচার্যের বক্তব্য থেকে বিষয়টি অনুধাবন করা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির আন্দোলনে তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি সর্বদা গ্রামবাংলার মানুষের মতো সাধারণ জীবনযাপন করেছেন, সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলেছেন। অনাহারক্লিষ্ট দুঃখী মানুষের মুখে দু'বেলা অন্নের সংস্থান, মোটা কাপড়, চিকিৎসা, বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করাই তার জীবনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল। বাঙালির হাজার বছরের আরাধ্য স্বাধীনতা এনে দিয়ে তিনি তার অভীষ্ট লক্ষ্যের পথে এগিয়ে যান। বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম জাতি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে তিনি বিশ্বের নিপীড়িত-নির্যাতিত ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে আদর্শরূপে আবির্ভূত হন। যতদিন পৃথিবীব্যাপী শোষণ-বঞ্চনা, নিপীড়ন-নির্যাতন, জাতিগত হানাহানি, অগণতান্ত্রিক শাসন-শোষণ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের অবসান না হবে, ততদিন বঙ্গবন্ধুর জীবন-দর্শন মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে আলোর পথ দেখাবে। সে কারণে 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিচ অ্যান্ড লিবার্টি' গবেষণা কেন্দ্রে দেশি-বিদেশি গবেষকরা স্বাধীনতা, মুক্তি, গণতন্ত্র, ক্ষুধা, দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করে বঙ্গবন্ধুর জীবন-দর্শনের আলোকে পথনির্দেশনা তৈরি করবেন। আমরা আশা করব, সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় এটি বিশ্বমানের গবেষণা সেন্টারে পরিণত হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গবেষকরা এখানে আসবেন। এখান থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে বঙ্গবন্ধুর জীবন-দর্শন ও বাঙালির গৌরবগাথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববাংলার পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মুক্তির দিশারি ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ জনপদের মানুষকে আত্মদর্শনের সন্ধান দেয়। আর বঙ্গবন্ধু সেই দর্শনের আলোকবর্তিকা হিসেবে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছে দেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল তার রাজনৈতিক দর্শনকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে একদিকে তার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা যাবে, অন্যদিকে বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির কাণ্ডারি হিসেবে তিনি ফিরে আসবেন বারবার।
সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
mrahim77@du.ac.bd
- বিষয় :
- মুজিববর্ষ
- মো. আবদুর রহিম