ঢাকা শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

দুর্যোগ

গোড়াকাটা উপকূলের আগায় পানি

গোড়াকাটা উপকূলের আগায় পানি

শেখ রোকন

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২০ | ১৪:৩৮

উপকূলীয় অঞ্চলের পরিস্থিতি যে ভালো নয়, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রায় নজিরবিহীন প্লাবনে উপকূলবাসী কীভাবে ভুগছে, গত কয়েক দিন ধরে সংবাদমাধ্যমের পাতা ও পর্দায় দেখছি তার খণ্ডচিত্র। সোমবারই সমকালে প্রকাশিত শিরোনাম- 'জোয়ারে জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত জীবন'। প্রশ্ন হতে পারে, জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলের জন্য আর নতুন কী?

বস্তুত দেশে যত ধরনের দুর্যোগ দেখা যায়, তার সবই ভোগ করতে হয় উপকূলবাসীকে। দেশের বাকি অংশের মতো বন্যা বা নদীভাঙন তো আছেই, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা ভোগ করতে হয় উপকূলকে একা। প্রতিদিন জোয়ার-ভাটাও উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়া দেশের বিপুল অংশকে স্পর্শ করে না। বাড়তি আপদ হিসেবে আছে লবণাক্ততা। এই যে বন্যা, একইভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যায় নদী ও অববাহিকা। কিন্তু উজানে যখন থাকে, তা 'মিঠা' পানি মাত্র। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূমি ও উর্বরতার জন্য উপকারী। সেই বন্যাই যখন উপকূলে গিয়ে মানুষের ঘরদোরে ওঠে, উজানের মতো নেমে যাওয়ার মধ্য দিয়েই তার রেশ শেষ হয়ে যায় না। বন্যা-পরবর্তী লবণাক্ততাও সামলাতে হয়।

এই চিত্রও উপকূলের জন্য নতুন নয়। আমরা যে লড়াকু বাংলাদেশের কথা বলে থাকি; প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে যে বাংলাদেশ টিকে থাকে ও এগিয়ে যায়; তার বড় অংশ আসলে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর লড়াই। বন্যা, নদীভাঙন, জোয়ার, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততার সঙ্গে লড়াই করেই তারা বসবাস করে আসছে হাজার বছর ধরে। জোয়ারে প্লাবন আসবে, ভাটায় নেমে যাবে। উজান থেকে বন্যা আসবে, কিছুদিন নদী অববাহিকা ভাসিয়ে শান্তভাবে সাগরে মিশে যাবে। এই তো উপকূলীয় জলজ জীবন! কিন্তু এবার সেই যে মে মাসে আম্পানের পাখনায় ভর করে জলে ভাসা জীবন শুরু হলো, এর আর যেন শেষ নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের বন্যা মৌসুমও নজিরবিহীন। ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, মেঘনা অববাহিকায় এর আগেও এক মৌসুমে একাধিক দফা বন্যা এসেছে। দু'বারের বেশি হলেই বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন। এবারও যখন বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা বন্যার আশঙ্কা প্রকাশ করছিল, তখন সংবাদমাধ্যমে সেই খবর পরিবেশিত হয়েছিল বিস্ময়সূচক চিহ্ন সহযোগে। এখন দেখা যাচ্ছে, গঙ্গা-যমুনা অববাহিকায় চতুর্থ দফা বন্যা পেরিয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে পঞ্চম দফা বন্যার পদধ্বনি।

উজানে তাও বন্যার 'দফা' গণনা করা সম্ভব হচ্ছে। উপকূলে মন্দের সেই ভালোটুকুও নেই। মে মাসে জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে বাঁধ ভেঙেছিল। পুরোনো ভাঙা দিয়ে প্লাবন প্রবেশ করেছিল। তারপর আর যাওয়ার নাম নেই। প্রথমদিকে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এলাকাবাসী ভাঙা বাঁধ মেরামত করেছিল। জমিনে জোয়ারের পর জোয়ার, আসমানে বর্ষণের পর বর্ষণ সেই প্রচেষ্টার বহুলাংশ ভেস্তে দিয়েছে। কমবেশি চার মাস ধরে, বলতে গেলে পানির মধ্যেই বাস করছে উপকূলবাসী। বলা বাহুল্য, সেই পানি লোনা। কাব্য করে বলা যেতে পারে, অশ্রুর মতো। কিন্তু বাস্তবতা উপমার চেয়ে কঠিন।

সোমবার প্রকাশিত সমকালে উপকূলবাসীর দুর্ভোগের চিত্র- 'সাতক্ষীরার মতো খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের বিস্তীর্ণ উপকূল এখন পানির নিচে। কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। সড়ক যোগাযোগসহ স্বাভাবিক জীবনযাপনে নেমে এসেছে মারাত্মক দুর্ভোগ। উপকূলীয় এলাকার নদনদীর পানি দু'কূল উপচে উঠেছে। এতে নতুন নতুন বাঁধ ভেঙে মাছ, ফসল ও মৌসুমি সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জোয়ারের তোড়ে বিধ্বস্ত হচ্ছে অনেক বাঁধ। নদীভাঙনও গতি পেয়েছে।' (সমকাল, ২৪ আগস্ট, ২০২০)।
 কেন এমন হচ্ছে? বিশেষজ্ঞদের নানা ব্যাখ্যা রয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সমকালকে বলেছেন, উপকূলীয় জেলাগুলোতে এই বন্যা পরিস্থিতি 'আকস্মিক'। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী এটাকে 'নিয়মিত' বন্যা হিসেবে দেখছেন। তার মতে, উজানে দফায় দফায় চলমান বন্যারই ধারাবাহিকতা। আবার আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মূল খলনায়ক মৌসুমি বায়ু। এর ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের উচ্চতা এক-দুই ফুট বেড়েছে, সঙ্গে রয়েছে উপকূলজুড়ে প্রবল বর্ষণ।

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে মনে হয়- গত কয়েক দশকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও উপকূল ব্যবস্থাপনার নামে আমরা নদী ও সাগরের ছন্দময় সম্পর্কে যে ছেদ ঘটিয়েছি, এ পরিস্থিতি তারই পরিণতি। নদনদীতে মিঠাপানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় ভূমি গঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সাগর এগিয়ে আসছে ডাঙার দিকে। নদী ভরাট হওয়ায় নিস্কাশন ব্যবস্থা বিনষ্ট। নদনদীকে বেড়িবাঁধ দিয়ে ঘিরে ফেলায় প্লাবনভূমির উচ্চতা বছর বছর বৃদ্ধির বদলে নদীর তুলনায় নিচু হয়ে যাচ্ছে। পানির প্রকৃতি নিম্নমুখী, কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে তা কতদিন ঠেকানো যায়? সেই বাঁধ ব্যবস্থা নিয়েও রয়েছে এন্তার কথা।

উপকূলজুড়ে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার বাঁধ নেটওয়ার্ক আমরা গড়েছি বটে, রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারে মনোযোগী হতে পারিনি। আম্পানের পর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের বক্তব্য দেখেছিলাম বিবিসি বাংলায়। তিনি বলছিলেন, বরাদ্দ বিপুল হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। তাহলে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে এমন ব্যয়বহুল ব্যবস্থা আমরা বেছে নিলাম কেন? আবার বরাদ্দের কত অংশ কাজে লাগে, সে নিয়েও প্রশ্ন পুরোনো। তার মানে, উপকূলীয় জল ও ডাঙার প্রাকৃতিক সম্পর্ক ব্যাহত করে আমরা যে প্রকৌশল বেছে নিয়েছি, সেটাও ঠিকমতো চলছে না। ফলাফল আশীর্বাদের উপকূলে দীর্ঘস্থায়ী অভিশাপ।

গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার নিষ্ম্ফলা প্রচেষ্টা নিয়ে বাংলা প্রবাদ রয়েছে। উপকূলীয় প্রতিবেশ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নদী-সাগর সম্পর্কে গোড়া কেটে ফেললে আগায় পানি চলে আসে আপনা আপনি। গত কয়েক দিন ধরে প্রাকৃতিকভাবেই জলে ভাসা উপকূলের জোয়ারে ডোবা চিত্র দেখে তাই মনে হচ্ছে। যে পানি ডাঙারেখার নিচে থাকার কথা, তা চলে আসছে বাড়িঘর, গাছ-গাছালির আগায় আগায়।

একটি আপ্তবাক্য বিশ্বজুড়েই পরিবেশকর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয়। আমি প্রথম শুনেছিলাম পরিবেশ আইনবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের কাছে- নদীকে সাগরের কাছে যেতে দিতে হয়। অন্যথায় সাগর নদীর কাছে চলে আসে। আর নদীর কাছে সাগর চলে আসার ফলাফল হয় ভয়ংকর। আরও ভেঙে বললে- সর্বগ্রাসী লবণাক্ততা, তার জের ধরে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন, যোগাযোগ ও আবাসন ব্যবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশে মারাত্মক বিপর্যয়।

আমরা দেখছি, উপকূলীয় নদী ও নদীনির্ভর ভূমি গঠন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে তোলার কারণে এখন উপকূলীয় জেলাগুলোতে সাগরই নদীর কাছে চলে এসেছে। ক্রমবর্ধমান উচ্চতা ও বিস্তৃতি নিয়ে জোয়ার প্রবেশ করছে, কিন্তু ভাটার টানে পুরোটা নেমে যাচ্ছে না। ঘরদোর, রাস্তাঘাট থইথই করছে লোনা পানিতে। ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই পচে যাচ্ছে। নতুন ফসল ফলানোর ফুরসত মিলছে না। লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ায় উপকূলীয় অঞ্চলের ফসলি জমিতে চিংড়ি বা কাঁকড়া চাষ জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই ঘেরও ভেসে যাচ্ছে চোখের সামনে।

উপকূলে এখনই যে বিপর্যয় আমরা দেখছি, তা সূচনামাত্র। যদি সময় থাকতে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে অপেক্ষা করছে আরও কঠিন সময়। কেবল উপকূল নয়, গোটা দেশের জন্য।

উপকূলের অসহায় বর্তমান বোঝার জন্য যেমন বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই; তেমনি এর ভবিষ্যৎ বোঝার জন্য জ্যোতিষী হওয়ারও প্রয়োজন নেই।

লেখক ও গবেষক; মহাসচিব, রিভারাইন পিপল

skrokon@gmail.com

আরও পড়ুন

×