রাজনীতি
মুজিববর্ষে ভুলে গেছি মুজিববাদ

এম আর খায়রুল উমাম
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১২:০০
বাংলাদেশের জনগণের একটা বিশাল অংশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রচারে নিবেদিত। যারা একসময় জন্মবিরোধিতায় ছিল, তারাও আজ নিজেদের জাতির পিতার সৈনিক বিবেচনায় গর্ব করে থাকেন। তারা সবাই জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিজেদের জীবন-যৌবন উৎসর্গ করে দিবানিশি শ্রম দিয়ে চলেছেন। এটাই স্বাভাবিক। বাঙালিকে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দেওয়া মহামানবের প্রতি প্রতিজন বাঙালিরই কৃতজ্ঞতা থেকে, শ্রদ্ধা থেকে, ভালোবাসা থেকে সম্মান জানিয়ে নিজেদের দেশ ও জনগণের কাজে ব্রতী করা প্রয়োজন। সেটাই শোভন। তাই আজ দলে দলে মানুষ যখন জাতির পিতার সৈনিক হিসেবে নিজেদের পরিচিত করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে তখন আনন্দিত হওয়ার কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই সৈনিকদের জীবনাচারে জাতির পিতার ছবি খুঁজে পাচ্ছে না। সোনার বাংলা গড়তে সোনার মানুষ বলে বিশ্বাস করতে পারছে না। পরিসংখ্যানের বাংলাদেশের সঙ্গে জাতির পিতার সোনার বাংলার মিল পাচ্ছে না। তবে কি এই সৈনিকরা জাতির পিতার আদর্শিক সৈনিক না হয়ে শুধু সৈনিক হয়েছে? অন্যভাবে বললে ব্যবসায়িক সৈনিক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, 'ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ গঠন করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক। শহীদদের রক্তদান সার্থক।' স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সরকার সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার নিয়ে দেশ শাসন শুরু করেছিল। দীর্ঘ পরাধীনতা থেকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা লাভের পর একটা মানবিক সমাজ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে যে যাত্রা শুরু, তা ধরে রাখা সম্ভব হলো না। বৈষম্য নিরসনের যে আশা সাধারণ মানুষের মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল, তা কর্পূরের মতো উবে যেতে সময় লাগল না।
মানবসমাজে বৈষম্য ছিল, আছে এবং থাকবে- এটা সত্য। তবে তা দিনে দিনে আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে, তা স্বপ্নের মধ্যে ছিল না। স্বাধীনতাপূর্ব 'সোনার বাংলা শ্মশান কেন' পোস্টার স্মরণে সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করেছিল, তাদের জীবনের অভাব-কষ্ট দূর করতে সমাধান হিসেবেই সমাজতন্ত্রের ভাবনা। দেশ শাসনে উন্নয়ন আর অগ্রগতির ঘেরাটোপে যে সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে সমাজতন্ত্রের কোনো পরশ পাওয়া যায় না।
বর্তমান সমাজে নগণ্য সংখ্যক মানুষ বিশাল সম্পত্তির মালিক। বিপরীতে জনগণের বিপুল অংশের হাতে সম্পদ নেই বললেই চলে। একদিকে জীবন উপভোগের সব সামগ্রী প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, অন্যদিকে ক্ষুধার অন্নের নিশ্চয়তা নেই। ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকা মানুষ যখন নিজেদের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে, তখন জাতির পিতার স্বপ্নের সমাজতন্ত্র তুলে রাখাই যায়। বিপরীতে জাতির পিতার সৈনিকরা দাবি করতে পারে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে দেশের সীমিত সম্পদে ৫০০ টাকার সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করা হয়েছে। দুঃখী অসহায় একজনের জন্য এর বেশি প্রয়োজন হয় না। দেশের সব মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের অংশ হিসেবে এই সামাজিক নিরাপত্তাবলয় কাজ করে চলেছে। এর মাধ্যমেই জাতির পিতার জীবন সার্থক করে তোলা হবে।
বিশ্বব্যাপী মানব জাতি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে মানবিক সমাজ গঠনের উৎস হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। আমাদের আর্থ-সামাজিক জীবনে গণতন্ত্র প্রচলন করে জাতির পিতা জীবন সার্থক করতে চেয়েছিলেন। জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেনাশাসন সেই গণতন্ত্রকে বারবার বাধাগ্রস্ত করে তোলে। গত শতকের নব্বইয়ের গণআন্দোলন তা থেকে মুক্ত করে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু যারা অঙ্গীকার করেছিল, তারা সেই অঙ্গীকার ভুলে গেছে। এখন জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার মহোৎসবে একবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন করার সংগ্রাম করতে হয়, তো আবার তা বাতিল করার সংগ্রাম করতে হয়।
আনুগত্যের ভক্তি দিয়ে জাতির পিতার জীবন সার্থক করা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় দলকে সরকারের বাইরে রাখা এবং দল ও সরকারে একই পদে পরপর দু'বারের বেশি দায়িত্ব পালন করতে না পারার বিধান করেই সর্বত্র সুষ্ঠু ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হলে জাতির পিতার জীবন সার্থক করা গণতন্ত্র আমরা পেতে পারি। আজকের গণতন্ত্রের জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ইচ্ছার অনুগত থাকার চেয়ে জনগণের প্রভু হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলায় প্রয়াসী। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জনগণের কল্যাণ ও স্বার্থ রক্ষায় নৈতিকতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করায় দেশের রাজনীতিতে নিত্যদিন মারামারি-কাড়াকাড়ি চলছে। একটা দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারের পরিবেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে জনগণের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে নিরাপদ রাখা যাচ্ছে না। মানুষকে জাতি-ধর্ম- বর্ণ-গোত্রের মাপে নয়; মানুষ হিসেবে মূল্যায়িত করতেই ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ।
আমাদের বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ ছিল না। সামরিক শাসকদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কৌশলের ফলে তার আগমন ঘটল। মৌলবাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জঙ্গিবাদের আবাদ শুরু হলো; সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। নিয়ন্ত্রণের নামে হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার জাতির জীবনে জেঁকে বসল। সব সৈনিক ডামাডোলের মধ্যে শিকারে ব্যস্ত হয়ে গেল। রাজনৈতিক বিবেচনায় একটা তুচ্ছ বিষয় দাবানল সৃষ্টি করে দিল।
জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল জাতীয়তাবাদ। জাতীয় জীবনে অভিন্ন চেতনার ঐক্য গড়ে তুলতে জাতি হিসেবে এক সূত্রে নিজেদের বাঁধা সম্ভব। আমাদের রাজনীতিতে পরমতসহিষুষ্ণতার অভাবে ঐক্য গড়া সম্ভব হয়নি। জাতীয়তাবাদকে বাঙালি না বাংলাদেশি বলা হবে- তার মীমাংসা করা হলো না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি করতে চলার সময় দেশ ও জাতির কল্যাণ বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞ মহল একটা মীমাংসার পথ সাধারণ মানুষের সামনে রাখবে- এমন প্রত্যাশা রাখি। অতীতে সম্প্রদায়ভিত্তিক যে জাতি-চেতনা গড়ে উঠেছে তা থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। সারাদেশে মুজিববর্ষ পালিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রবল আক্রমণে বর্ষটি আড়ম্বরে পালন করা গেল না। তবে ডিজিটালি পালনে আমরা পিছিয়ে নেই। মুজিববর্ষের সূচনায় যে আতশবাজির ঝলমলে আলো ছড়ানো হয়েছিল, সেই আলোতে জাতির পিতার নব্য সৈনিকদের দ্যুতি সাধারণ মানুষের সামনে এসেছে।
এমন পরিস্থিতিতে কি জাতির পিতার জীবন সার্থক করা সম্ভব? তারা কি সোনার বাংলা গড়ার সোনার মানুষ? তাই বোধ করি, এখন আর কেউ মুজিববাদ নিয়ে কথা বলতে চায় না। মুজিববাদ হারিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে হারিয়ে গেছে দেশের সাধারণ মানুষকে নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্ন মর্যাদার ব্যক্তিজীবন, সাম্যের সামাজিক জীবন, সমান সুযোগের আর্থিক জীবন, সংস্কারমুক্ত সাংস্কৃতিক জীবন, সর্বোপরি মৌলিক অধিকার রক্ষার জীবন।
আজ সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে সহ্যসীমার মধ্যে রাখতে এগিয়ে আসতে হবে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে; মুজিববর্ষে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠায় আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে। দেশ ও মানবপ্রেমের চেতনায় সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে দুর্নীতি ও শোষণ দূর করতে মুজিববাদ হোক প্রেরণার উৎস। জাতির পিতার সৈনিকরা সংযমী মানুষ হিসেবে সমাজে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে সাধারণ মানুষের কাছে বিবেকবান মানুষ বিবেচিত হোন। নিজের স্বার্থে দেশ ও জনগণের ক্ষতি না করে সুখ-দুঃখের ভাগীদার হোন। মুজিববর্ষে জাতির পিতার প্রতি অতল শ্রদ্ধা।
প্রাবন্ধিক; সাবেক সভাপতি,
ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স,
বাংলাদেশ (আইডিইবি
- বিষয় :
- রাজনীতি