গণতন্ত্র
আমরা প্রকৃত 'সাংসদ' হতে চাই?

রুমিন ফারহানা
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২০ | ১৪:০৩
সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কেমন? উত্তর- ভীষণ সহজ আবার ভীষণ কঠিন। সংসদে আমার স্বল্প সময়ের অভিজ্ঞতা বলে, কেউ চাইলে তার সংসদ সদস্য জীবনের পুরো সময়টা একটি বাক্য ব্যয় না করে কিংবা কেবল মেঠো বক্তৃতা করেই পার করতে পারে। এটাই সহজ পথ; এ কারণেই বাংলাদেশে 'ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান' এত কম। অবশ্য সংসদ সদস্যদের আরও যেসব জায়গায় জড়িত করে রাখা হয়, আমরা কীভাবে প্রত্যাশা করি সংসদ সদস্যদের 'মূল দায়িত্ব' পালনে আগ্রহ থাকবে?
'আইনসভা' বলে পরিচিত হলেও সংসদের কাজ এর বাইরেও ব্যাপ্ত। মোটামুটিভাবে বলা যায়, মূল কাজ আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করার সঙ্গে সঙ্গে সংসদ নানা বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন ও পর্যালোচনা করবে, জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।
এসব কাজ কি হচ্ছে? অতীতের মতো টিআইবির পার্লামেন্ট ওয়াচ ২০২০ প্রতিবেদন আমাদের জানায়, সংসদ তার ভূমিকা পালন করছে না। প্রতিবেদনে দেখা যায়, একাদশ সংসদের পাঁচটি অধিবেশনে আইন প্রণয়ন কার্যক্রমে ৯ শতাংশ সময় ব্যয় হয়েছে। ভারতের ১৭তম লোকসভায় এই হার ছিল ৪৫ শতাংশ; আমাদের ৫ গুণ। বাংলাদেশে উত্থাপনসহ প্রতিটি বিল পাস করতে গড়ে প্রায় ৩২ মিনিট সময় ব্যয় হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভায় প্রতিটি বিল পাস হতে সময় লাগে গড়ে ১৮৬ মিনিট। অর্থাৎ আমাদের প্রায় ছয় গুণ।
সংসদে উপস্থিত থাকার ব্যাপারেও সংসদ সদস্যদের অনীহা রয়েছে; ফলে প্রায়শই দেখা দেয় 'কোরাম সংকট'। ৩৫০ সদস্যবিশিষ্ট সংসদে কোরাম পূর্ণ হতে লাগে মাত্র ৬০ জন। ২০১৯ সালের পাঁচটি অধিবেশনে মোট ১৯ ঘণ্টা ২৬ মিনিট কোরাম সংকট ছিল বলে জানিয়েছে টিআইবি। যা পাঁচটি অধিবেশনের প্রকৃত মোট ব্যয়িত সময়ের ১৭.৩ শতাংশ। প্রথম হতে পঞ্চম অধিবেশন পর্যন্ত কোরাম সংকটে ব্যয়িত মোট সময়ের অর্থমূল্য ২২ কোটি ২৮ লাখ ৬৩ হাজার ৬২৭ টাকা।
টিআইবি শুধু কোরাম সংকটের ব্যয়ের হিসাব করেছে। সংসদ অধিবেশন চলাকালীন সংসদে অপ্রাসঙ্গিক বক্তৃতার নামে যে সময়ের অপচয় হয়, সেই অপচয়ের আর্থিক মূল্যের হিসাব করেনি। আশা করি, ভবিষ্যতে কোনো রিপোর্টে টিআইবি দেখাবে একেবারে অপ্রয়োজনীয়, অপ্রাসঙ্গিক এবং অনুৎপাদনশীল কাজে সংসদে কতটা সময় নষ্ট হয় এবং সেটার অর্থমূল্য কত।
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, আমাদের কিছু আইন কি সংসদ সদস্যদের 'অন্যত্র ব্যস্ত' রাখে? উপজেলা পরিষদ আইনের ২৫ ধারায় সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ৩০০ এমপিকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করা হয়েছে এবং তার পরামর্শ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এমনকি সংসদ সদস্যকে অবহিত না করে উপজেলা পরিষদের পক্ষে সরকারের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ করাও সম্ভব নয়।
আইনের এ ধারাটির দ্বিমুখী সমস্যা আছে। এ ধারার কারণে প্রকারান্তরে উপজেলা পরিষদকে সংসদ সদস্যের প্রভাবের অধীন করা হয়েছে, যেটা একটা স্বাধীন, নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের ধারণার পরিপন্থি। সংবিধানের 'স্থানীয় শাসন' সংক্রান্ত ৫৯ ও ৬০ ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বহু এলাকায় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্যের মতদ্বৈততা এবং অনেক ক্ষেত্রে সংঘাতের খবর আমরা সংবাদমাধ্যমে পাই। বাংলাদেশের মতো একটা এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র শক্তিশালী স্বাধীন স্থানীয় সরকার ছাড়া সুশাসন নিশ্চিত করতে পারবে না। জনগণ নানারকম সেবা থেকে বঞ্চিত হবেই। সংসদ সদস্যদের কারণেই এ সেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সংসদ সদস্যদের একটা অংশ পরিপূর্ণ মনোযোগ রাখেন স্থানীয় সরকারের প্রকল্পগুলোর প্রতি। একটা হিসাব দেখে নেওয়া যাক। এ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। প্রতিবারের মতো এবারও কাটছাঁট হয়ে এটা যদি ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকাও হয়, তাহলে প্রতি সংসদীয় আসনে গড় বরাদ্দের পরিমাণ হয় ৫৬৬ কোটি টাকা। মনোযোগের কারণ সহজেই অনুমেয়। এটা এক বছরের হিসাব। একজন এমপি থাকবেন পাঁচ বছর আর প্রতি বছর এডিপির বরাদ্দের পরিমাণ বাড়তে থাকবে।
প্রত্যেক সংসদ সদস্যের নামে আছে টিআর-কাবিখা-কাবিটার বরাদ্দ। এটা ছাড়াও নানা মন্ত্রণালয়ের নানা রকম তহবিল থেকে সংসদ সদস্যরা অনুদান নিতে পারেন। এ বরাদ্দ ও তার বাস্তবায়ন নিয়েও অনিয়মের অনেক অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে আসে। যদি অনিয়ম নাও হয়, সংসদ সদস্যরা উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টার কাজ কিংবা টিআর-কাবিখা-কাবিটা বণ্টন নিয়ে অনেক বেশি সময় ও মনোযোগ ব্যয় করেন। কারণ এসব কাজ দেখিয়ে তিনি আগামী নির্বাচনে ভোট চাইতে পারবেন।
সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য হিসেবে উপজেলার উপদেষ্টা আমি নই। কিন্তু আমার হাতে আসা টিআর-কাবিখা-কাবিটা সঠিক বণ্টন ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন তদারকি করতে গিয়ে দেখেছি, কতটা সময় ও মনোযোগ ব্যয়িত হয়। তাই এই সংসদেই আমি এই দুটো প্রকল্প সংসদ সদস্যদের নামে বরাদ্দ বাতিল করার দাবি করেছিলাম।
আমাদের দেশে সংসদ সদস্য হওয়া খুব 'লাভজনক' বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে। এ কারণেই আমরা 'মনোনয়ন বাণিজ্য' বলে একটা কথা হামেশা শুনি। মোটা টাকা দিয়ে মনোনয়ন কিনে, নির্বাচিত হওয়ার জন্য মোটা টাকা ব্যয় করে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের এরপর সেই বিনিয়োগ উঠিয়ে আরও অনেক লাভ করার প্রতিই মনোযোগ বেশি থাকবে। এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দেশের সবসময়ই সরকার মনে করে যে, সংসদ সদস্যদের হাত দিয়ে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করালে ভবিষ্যতে সংসদ সদস্য এবং তাদের দল নির্বাচিত হয়ে আবার ক্ষমতায় আসতে পারবে। এ চিন্তা থেকেই বেশিরভাগ সদস্য সংসদে কার্যপ্রণালি বিধির বিভিন্ন ধারায় তাদের বক্তব্য বা প্রশ্নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয় এড়িয়ে এলাকার সমস্যাকেই প্রাধান্য দেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে যাওয়া বাংলাদেশের মানুষের বুঝতে হবে, একটা সংসদ নির্বাচনে মানুষ ভোট দেবে একটা দলের সার্বিক কর্মকাণ্ড বিবেচনা করে। মানুষ যেন বুঝতে পারে রাষ্ট্রে একটা কল্যাণমুখী সরকার থাকলে নির্বাচিত স্বাধীন স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে সবরকম সেবা এবং উন্নয়ন তাদের কাছে পৌঁছে যাবে।
খুব বড় সমস্যা আছে আরেকটা। আলোচনার খাতিরে ধরে নিলাম, সংসদ সদস্যদেরকে এসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা হলো। সত্যিকার অর্থেই সংসদের ভূমিকা রাখার মতো যোগ্য, রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত নাগরিকরা সংসদ সদস্য হিসেবে সংসদে এলো। তাহলেও কি এই সংসদ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতে পারত?
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ খুব শক্ত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে এ পথে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদে দলের বিরুদ্ধে কেউ ভোট দেওয়া মাত্রই তার সংসদ সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায়। কোনো দল একটি মাত্র আসন বেশি পেয়ে সরকার গঠন করতে পারলেই কার্যত সেই দলের প্রধান যা চাইবেন, ঠিক তা-ই হবে। এই অনুচ্ছদের কারণে সংসদ আদতে একটা রাবার স্ট্যাম্পের চাইতে বেশি কিছু হয় না। সেই সংসদে কেউ যুক্তি-প্রজ্ঞা-জ্ঞান-তথ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দুর্দান্ত পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তার খ্যাতি আসতে পারে। এর বেশি কিছু হবে না।
সংবিধান এবং আইনের এই বিষয়গুলো ঠিক করা হলেও কালই একটা অসাধারণ কার্যকর সংসদ আমরা পেয়ে যাব না। তবে এটা নিশ্চিত, তেমন একটা সংসদ পাওয়ার পথে আমাদের পথচলা শুরু হবে জোরেশোরে। দুর্ভাগ্য আমাদের, সেই যাত্রা শুরুর প্রাথমিক পদক্ষেপটাও নেওয়া হবে কবে, সেটাও জানি না আমরা।
সংসদ সদস্য, আইনজীবী ও কলাম লেখক
- বিষয় :
- গণতন্ত্র
- রুমিন ফারহানা