বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ
সর্বাত্মক প্রচেষ্টার বিকল্প নেই
এসএম পারভেজ -সংগৃহীত ছবি
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২০ | ১২:০০
চলমান করোনা দুর্যোগের প্রভাবে দেশে যেভাবে বাল্যবিয়ে বেড়েছে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ থাকার পরও এটি নিয়ন্ত্রণে না আসা হতাশাজনক। মঙ্গলবার সমকাল ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের যৌথ ভার্চুয়াল সংলাপে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে তাই সর্বাত্মক প্রচেষ্টার যে দাবি উঠেছে, আমরা তার সঙ্গে একমত। তিন পর্বের ওই ভার্চুয়াল সংলাপে গত মাসে অনুষ্ঠিত দুই পর্বেও বক্তারা আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সমন্বিত উদ্যোগ বিষয়ে জোর দেন। সমকাল বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি দায়িত্ববোধ থেকেই যে সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সোচ্চার। বাল্যবিয়ে রোধে ভার্চুয়াল সংলাপ তারই অংশ। আমরা দেখছি, দেশে অর্ধেকেরও বেশি মেয়ের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়ার ফলে একদিকে যেমন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি অল্প বয়সে গর্ভবতী হওয়ার কারণে মা ও নবজাতকের মৃত্যুহার বাড়ছে। তা ছাড়া অল্প বয়সের মেয়ে যেখানে নিজের সম্পর্কেই সচেতন নয়, সেখানে একটি পরিবারের দায়িত্ব সে কীভাবে নেবে? এতে পারিবারিক অশান্তি ও পারিবারিক নির্যাতনের পাশাপাশি বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটে। ফলে বাল্যবিয়ের প্রভাব ব্যক্তি কিংবা পরিবার ছাপিয়ে সমাজ ও দেশের ওপরেও পড়ছে। বাল্যবিয়ে যে একটি মেয়ের জন্য মানবাধিকার লঙ্ঘন- তা ভার্চুয়াল সংলাপে উঠে এসেছে। এর ফলে মেয়ের বেড়ে ওঠা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হয়। বক্তারা যথার্থই বলেছেন, নারীর নিরাপত্তাও বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে যেখানে সমাজে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ বাড়ছে, সেখানে কোনো কোনো অভিভাবক মনে করেন, মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারলেই বোধ হয় বাঁচা গেল। মঙ্গলবার এমন সময়ে এ ভার্চুয়াল সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয়, যখন আমরা দেখছি, নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে দেশে সামাজিক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। অস্বীকার করা যাবে না যে, করোনাকালে দারিদ্র্যের হার বাড়ার সঙ্গে কন্যা ও নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ার সম্পর্ক আছে। আমরা দেখছি, করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলবিমুখ হয়ে পড়ছে। তাতে বেড়ে যাচ্ছে বাল্যবিয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে দেরি হলে বাল্যবিয়ে আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। আমরা মনে করি, বাল্যবিয়ে রোধে বহুমুখী পদক্ষেপ দরকার। একদিকে যেমন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি, তেমনি এ আইন বিষয়ে সচেতনতাসহ মেয়েদের প্রতি পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তাছাড়া বিয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে বাল্যবিয়েরোধী আন্দোলনে সংযুক্ত করতে হবে। বাল্যবিয়ে কেবল নারীর বিষয় নয়; সামাজিক এ সমস্যা মোকাবিলায় সমাজের পুরুষদেরও সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ভার্চুয়াল অংশ নিয়ে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, শুধু সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব নয়। তবে আমরা মনে করি, সর্বাগ্রে প্রশাসনকেই সজাগ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তৎপরতা প্রয়োজন। এলাকায় বিয়ে হলে তাদের অজানা থাকার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে কনের বয়স কত, বাল্যবিয়ে হচ্ছে কিনা। বাল্যবিয়ে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিতকরণের দায়িত্ব সর্বাগ্রে তাদের ওপরেই বর্তায়। বাল্যবিয়ে রোধে জাতীয় হেল্পলাইনের উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং সেখানে করোনার মধ্যে ৯ লাখ কল এসেছে বলে প্রতিমন্ত্রী যে তথ্য জানিয়েছেন, তা ইতিবাচক বলে আমরা মনে করি। অনেক এলাকায় অভিভাবকরা অল্প বয়সী মেয়েদের রাতে বিয়ে দেন বলে প্রশাসনের ২৪ ঘণ্টা মোবাইল কোর্টের উদ্যোগও অভিনব। আমরা চাই, জন্মনিবন্ধন সনদ ব্যতীত কোনো অবস্থায়ই ম্যারেজ রেজিস্ট্রার যেন বিয়ে নিবন্ধন না করেন। করোনার এ দুর্যোগ পরিস্থিতিতে যেসব পরিবারের আয় কমে গেছে, যেসব দরিদ্র পরিবার মেয়েদেরকে পরিবারের জন্য বোঝা মনে করে, তাদের কেবল বোঝালেই হবে না; একই সঙ্গে সেসব পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া জরুরি। নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৫০ শতাংশে উন্নীত করার অঙ্গীকার করেছেন। এ অবস্থায় বাল্যবিয়ে চলতে পারে না। এটি প্রতিরোধ করতেই হবে।
- বিষয় :
- বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ