ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

নিরাপত্তা

জঙ্গিরা মানবতার শত্রু

জঙ্গিরা মানবতার শত্রু

সুধীর সাহা

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০

গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সে গন্ধ বিতরণ করবেই। কথাটা বলেছিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়র। নামটা বড় নয়, কাজটা বড়। এ তো গেল সুগন্ধের কথা। দুর্গন্ধের সত্যতাও কিন্তু একই। নাম পাল্টে দিলেও তাদের চরিত্র বদলায় না, দুর্গন্ধ ছড়াবেই। আল কায়েদা, আইএস, এলটিটিই, মাওবাদী বা লস্কর-ই-তৈয়বা সবারই চরিত্র এক। নাশকতা চালানো আর সুস্থিতি বিনষ্ট করাই তাদের উদ্দেশ্য। সব জঙ্গিগোষ্ঠীই মানবতার শত্রু। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় হুমকি এই জঙ্গিবাদ। যে দেশ তা সময়মতো বুঝতে অসমর্থ হয়ে যায়, তাদের মাশুল দিতে হয় অনেক বড় করে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের দিকে তাকালেই এই সত্যতার বাস্তব চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। জঙ্গি হয়ে কেউ জন্মগ্রহণ করে না, জঙ্গি তৈরি করা হয়। বঞ্চনার অভিমানকে উস্কে দিয়ে তোলা হয় প্রতিহিংসার নেশা। তাকে উস্কে দেওয়া হয় সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, উস্কে দেওয়া হয় মানবতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, উস্কে দেওয়া হয় সরকার ও সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। শিক্ষা দেওয়া হয়, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করতে হবে মানবতার সোপানগুলোকে। দুর্ভাগ্য, সেই লক্ষ্য পূরণে পবিত্র ধর্মকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কাজে লাগানো হয়।
জাতিসংঘের নিষিদ্ধ তালিকায় থাকা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক জঙ্গিগোষ্ঠীর অবস্থান পাকিস্তানে। পাকিস্তান ওসামা বিন লাদেনকে শুধু আশ্রয় দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি বরং তার মৃত্যুর পরে তাকে 'শহীদ' বলে আখ্যায়িত করেছিল। পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শুধু লাদেনের আশ্রয়স্থলই ছিল তা শুধু নয়, আজও বহু জঙ্গি সংগঠনের নেতারা অ্যাবোটাবাদে তাদের গোপন আস্তানা তৈরি করে রেখেছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গণহত্যার সূত্রপাত হয় পাকিস্তান থেকেই। ৪৯ বছর আগে পাকিস্তান তারই প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনা করেছিল। এরপর দেশটি আর জঙ্গি তৎপরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। পরের ঘরে সন্ত্রাসে জড়িত জঙ্গিদের তারা আশ্রয় দিয়েছে, তাদের লালন-পালন করেছে। একদিন তাদেরই বড় বড় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে পাকিস্তান নিজে। মসজিদ, স্কুল, সরকারি প্রতিষ্ঠান কিছুই বাদ যায়নি সন্ত্রাসী আক্রমণের হাত থেকে। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সীমান্তবিরোধ, কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ চলছে তো চলছেই। সেই বিরোধে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সন্ত্রাসবাদ। সেই সন্ত্রাসবাদকে সাদরে লালন করেছে পাকিস্তান। আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে জঙ্গিরা নির্বিঘ্নে পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকার পথ পেয়েছে।
'তোমার ঘরে বসত করে কারা, ও মন জানো না, তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা'- লালন শাহর আত্মজিজ্ঞাসা যদি দেহতত্ত্বের সীমানা পেরিয়ে সমাজতত্ত্বের গভীরে আমাদের আকৃষ্ট করত, তাহলে হয়তো অনেক বিতর্কেরই সূত্রপাত হতো না। উপমহাদেশের সামাজিক অনৈক্য ও সংঘাতের মূলে রয়েছে বহুধাবিস্তৃত পরিচয় অথবা সঠিকভাবে বললে বলতে হয় অপরিচয়। বিভাজিত বর্ম ভেদ করে, মনুসংহিতার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সহস্র বছর ধরে সবার কাছে সবাই পৌঁছতে পারেনি। প্রত্যাশা ছিল, স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক চেতনায় বিভাজনের ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে উঠবে নতুন দেশ। অথচ বাস্তবে তা হয়নি। আত্মিক দাসত্ব মোচনের জন্য যে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন, তা সাধন করে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানো পরিপূর্ণভাবে আজও সম্ভব হয়নি। এ সুযোগটাই গ্রহণ করে উগ্রবাদীরা। তারা বিচ্ছিন্ন মানুষের হৃদয়ে আরও চিড় ধরিয়ে পৃথক সত্ত্বা জাগিয়ে তোলার অশুভ চেতনা জাগরিত করে। করোনাকালেও তারা কিন্তু ঘরে বসে নেই। জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের ওপর গবেষণা বিভাগের পরিচালক আলেকজান্ডার মালেয়াগ্রৌ-হিচেন্স সম্প্রতি ওয়াশিংটন টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- জঙ্গিরা বরং জিহাদিদের উদ্দেশে এই বার্তা রটিয়ে দিয়েছে যে, শত্রু এবং নাস্তিকদের শায়েস্তা করার জন্য করোনা আসলে সৃষ্টিকর্তার পাঠানো একটি সুযোগ। এটিকে কাজে লাগাতে হবে। আমেরিকান ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিজের বিশিষ্ট অ্যানালিস্ট বিল রোজিও বলেন, তালেবান এবং আল কায়দার মতো কিছু সন্ত্রাসবাদী সংগঠন প্রচার করছে যে, করোনা হলো অধঃপতনে যাওয়া পশ্চিমা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ঈশ্বরের এক চরম আঘাত। তারা মনে করে, আঘাতের এটাই সুবর্ণ সুযোগ। এই সময়ে আঘাত হানতে পারলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করা যাবে। কারণ, দেশগুলোর সরকার এখন করোনা মোকাবিলা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত।
দেশকে রক্ষা করতে, দেশের মানুষকে রক্ষা করতে জঙ্গিবাদকে প্রতিহত করার বিকল্প নেই। কাজটি সহজ নয়। কারণ, বিচ্ছিন্নতাবাদ খুব বড় হয়ে সমাজে বিরাজ করছে। ধর্মীয় বিদ্বেষ জঙ্গিবাদকে উস্কে দেওয়ার প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজ করে। সমাজ থেকে সন্ত্রাস দূর করতে হলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করার ওপর আরও বেশি জোর দিতে হবে। উপমহাদেশে জঙ্গিবিরোধী তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি বন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভুটান ও নেপালকে কাজ করতে হবে। জঙ্গিবাদী কোনো সংগঠন কিংবা জঙ্গিবাদ লালনকারী কোনো দেশই চূড়ান্তভাবে সফল হতে পারেনি। প্রাণ দিয়েছে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। ঘরহীন, সমাজহীন জঙ্গিরা মানুষের ঘর কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও সফলকাম হতে পারেনি কখনও। আল কায়দা, আইএস কিংবা এলটিটিই কেউই শান্তি খুঁজে পায়নি অন্যের জন্য কিংবা নিজেদের জন্য। পাকিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। সন্ত্রাসের থাবা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ। তার প্রধানতম কারণ হলো তারা নিজেরা বিভাজিত। 

অবসরপ্রাপ্ত মেজর, কলাম লেখক
ceo@ilcb.net

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×