ঢাকা বুধবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

বিজয়ের মাস

কিশোরীর চোখে সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ

কিশোরীর চোখে সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধ

জেসমিন আরা বেগম

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০

সুনামগঞ্জ শহর আমার জন্মস্থান। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বের শেষ ছোট্ট মহকুমা শহর, শান্ত নিরিবিলি, হাওর আর পাহাড়ের মাঝে এক বিচ্ছিন্ন এলাকা। কিন্তু এই শান্ত শহরের মানুষ বড়ই উচ্ছল। বড়ই আবেগপ্রবণ। মুক্তিযুদ্ধ বা তৎপূর্ববর্তী এমন কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম নেই, যেখানে সুনামগঞ্জের ছাত্র-জনতা শামিল হয়নি। আসাম প্রদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বহু রাজনৈতিক নেতা জন্মেছেন এই সুনামগঞ্জে, যাদের শ্রমে ঘামে মেধায় মননে ধীরে ধীরে স্বাধীনতা নামক সোনার হরিণ ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছে এই প্রজন্ম। আমার বাবার নাম সোনাওর আলী অ্যাডভোকেট, সুনামগঞ্জ বারে যোগ দেন ১৯৫৯ সালে। ঢাকায় পড়ার সময় জড়িয়ে পড়েন বাম রাজনীতিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল হলে তার রুমমেট ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। দুই বন্ধু একসঙ্গে বাম রাজনীতিতে দীক্ষা নেন। পরে সামাদ চাচা আওয়ামী লীগে যোগ দেন, বাবা যোগ দেন ন্যাপে। আমার বড় ভাই গোলাম রব্বানী, যাকে আমরা দাদা বলতাম, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা।
১৯৭০ সালে শহর প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী আমি। বৃত্তি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। চারদিকে নির্বাচনের আমেজ। সামাদ চাচা বারবার সুনামগঞ্জ আসছেন। বাবা অন্য পার্টি করলেও বন্ধুত্ব অটুট ছিল। আমাদের বাসায় তিনি আসতেনই। রাতে বারান্দায় বসে আব্বা আর তিনি গভীর আলোচনায় মগ্ন হতেন।
এরই মাঝে সাজসাজ রব পড়ে যায়- বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব যিনি ইতোমধ্যে 'বঙ্গবন্ধু' খেতাব পেয়েছেন তিনি সুনামগঞ্জ আসছেন। সামাদ চাচা বারবার সুনামগঞ্জ আসছেন। সব দলের নেতারা উন্মুখ বঙ্গবন্ধু এসে কী বলেন। শহরে মিছিলের ভাষায় আরও এক পালক যোগ হয়- 'স্বাগতম শেখ মুজিব লও লও লও সালাম'। ছাত্রদের মাঝে, বড়দের মাঝে এক অন্য ধরনের উত্তেজনা। আমরা ছোটরাও উত্তেজিত। সড়কপথে এসে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আমাদের বাসার সামনে দিয়েই শহরে ঢুকবেন। সকাল থেকে শত শত ছেলেমেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি- বড়-ছোট স্কুল-কলেজের ছাত্র সবাই। আমিও দাঁড়িয়ে পড়ি আমাদের বাসার সামনেই। একটা সবুজ রংয়ের জিপে করে সেই দীর্ঘদেহী জননেতা তার দীর্ঘ হাত তুলে অভিবাদন জানিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই দীর্ঘ হাত আর একটুখানি মুখ দূর থেকে দেখা, আজও চোখে ভাসে। আব্বা জনসভায় চলে যান আর আমরা অধীর আগ্রহে মাইকে তার গমগমে কণ্ঠস্বর শুনি। ইতিহাসের কিংবদন্তির কণ্ঠস্বর!
শুনতে পাই, প্রাদেশিক পরিষদে আমার দাদা গোলাম রব্বানীকে দিরাই আসনে ন্যাপ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এক রাতে আব্বার কাছে দাদা জানতে চান, তিনি কী করবেন? বরুণ দা বা বরুণ রায় চাচ্ছেন সেন দা মানে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অনুকূলে আসন ছেড়ে দিতে। আব্বার উত্তর ছিল এই নির্বাচন স্বাধিকার আদায়ের নির্বাচন। যেভাবেই হোক শেখ মুজিবের হাত শক্তিশালী করতে হবে। স্বাধিকার আদায় হলে সমাজতন্ত্র আনা দুস্কর হবে না। জীবনে অনেক সুযোগ আসবে। এই মুহূর্তে বরুণ দার কথা শোনা তার কর্তব্য। দাদা সরে এসেছিলেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সেখানে প্রার্থী হন। যদিও আর কখনও নির্বাচন করার সুযোগ দাদার হয়নি। নির্বাচনে সুনামগঞ্জ শহরের প্রার্থী দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরীর মার্কা নৌকা। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও দিরাইয়ে আব্দুস সামাদ আজাদ চাচা। প্রাদেশিক পরিষদে রইছ চাচা, জহুর চাচা, হেকিম চাচা, সেন দা আরও অনেকে। এ সময় সারা শহর এক নতুন স্লোগানে মুখর থাকত 'জয় বাংলা'। আওয়ামী লীগ-ন্যাপ সবাই একই স্লোগান দিত। আমি শহর প্রাইমারি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। হেড মাস্টার দীর্ঘদেহী ঋষিসম হরেন্দ্রলাল সেন। তিনি আমাদের স্কুলের ৫/৬ জনকে বৃত্তির জন্য সিলেক্ট করেছেন। তখন সিলেকশন প্রক্রিয়া ছিল খুব কঠিন। তার জন্য আলাদা পরীক্ষা দিতে হতো। সিলেক্ট হলে স্কুলই দায়িত্ব নিত তাকে তৈরি করার। এ কারণে হেড মাস্টার স্যার আমাদের ২টার পর পাঠিয়ে দেন রাজগোবিন্দ স্কুলে কোচিং করার জন্য। তার ভাই দীজেন্দ্র লাল সেনের কাছে। তিনি কানে কম শুনতেন। কিন্তু বৃত্তির ছাত্র গড়তে তিনি কিংবদন্তি ছিলেন।
ছুটির দিনে স্যারের বাসায় সকাল থেকে যেতে হতো। উকিলপাড়ায় লম্বা বাসার অপজিটে একটা মুদির দোকান থেকে চার আনার তেঁতুল কিনে লবণ-মরিচ দিয়ে মানিক আর বাঁধনের সঙ্গে ভাগ করে তেঁতুল খেতে খেতে বই-খাতা হাতে রওনা হতাম আর নৌকা নৌকা-কুঁড়েঘর কুঁড়েঘর স্লোগান দিতে দিতে পথ চলতাম। সামনেই ছিল পিডিপির মাহমুদ আলী সাহেবের বাসা। তারা খুব সম্মানিত মানুষ। আসাম গভর্নমেন্টের সময় থেকে এই বাসা মিনিস্টার বাড়ি। আর মাহমুদ আলী সাহেব নিজেও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছেন। তা সত্ত্বেও পিডিপি থেকে দাঁড়ানোতে কোণঠাসা। কে শিখিয়ে দিয়েছিল মনে নেই; ছড়া কাটতাম আমরা- 'বাট্টি-গুট্টি পিডিপি নেতা ইলেকশন আসিলে/ দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফিরে সকালে বিকালে।'

বিকেলে স্যারের বাসা থেকেই দেখতাম নৌকা বানিয়ে সামনে নিয়ে বিরাট মিছিল। পরক্ষণেই কুঁড়েঘরের মিছিল। এ যেন এক উৎসব। মিছিলের শব্দ পেলেই আমরা স্যারের বাসায় দরজার সামনে চলে যেতাম, সবাই তারস্বরে স্লোগান দিতে থাকতাম। স্যার বেত দিয়ে মেরেও আমাদের ক্ষান্ত করতে পারতেন না। মাঝে মাঝে বেত নিয়ে মারতে মারতে স্কুলে নিয়ে যেতেন। তিনি বেত হাতে পেছনে, সামনে আমরা। তথাপি স্লোগান দেওয়ার সময় ঠিকই গলা মেলাতাম। আর বেত খেতাম। ডিসেম্বরে হয় কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন। নৌকার বিপুল বিজয়। সারাদেশের মাঝে একটা কুঁড়েঘরের সিট। তাও সুনামগঞ্জে, সেন দা। আমাদের বাসায় বিরাট জমায়েত। সবাই খুশি। কিন্তু না বড়দের টেনশন শেষ হয় না। আরও অনেক কিছু নাকি বাকি। আমরা বৃত্তির জন্য মনোযোগ দিই। জানুয়ারিতে বৃত্তি শেষ হয়। আব্বা সতীশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে আমাকে ভর্তি করে দিয়েছেন। কিন্তু ক্লাস হওয়ার নাম নেই। শহরে শান্তি নেই। বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন। শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী করবে তো? এত সহজে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ফলাফল মেনে নেবে তো? কী হচ্ছে ঢাকায়? ছয় দফা বাস্তবায়ন কি এত সহজে হবে? সবাই তাকিয়ে আছে তাদের  প্রিয় নেতার দিকে। এখন আর কোনো পার্টি নেই- সবাই একাট্টা। জাতীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছে।
মার্চ মাসের প্রথমেই জাতীয় সংসদ বসার কথা, বসছে না। ২ তারিখ থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন, সবার অফিস-আদালত বন্ধ। স্কুল-কলেজের তো কথাই নেই। ঢাকায় নাকি স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে ছাত্ররা। সুনামগঞ্জেও পতাকা তৈরির হিড়িক পড়ে। মতিউর মামা, কালা সফিক, শহীদ ভাই, দাদারা মিলে এসডিও অফিসের সামনে পতাকা টানান। শিল্পীরা রাস্তায় রাস্তায় ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, আর আমার সোনার বাংলা গান গেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আসে ৭ মার্চ। দুপুরের দিকে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। সবাই কানের মাঝে রেডিও নিয়ে তটস্থ- কী আদেশ আসে। রেডিওতে কিছু শোনা যায় না। পরদিন রেডিও ভাষণ সম্প্রচার করে। বারবার সম্প্রচার করে। ভাষণ শুনে সবাই রাস্তায় নেমে আসে, বুঝে যায় যুদ্ধ আসন্ন। ২৫ মার্চ আমরা ঘুমিয়ে গেছি, রাত ২/৩টার দিকে প্রচণ্ড জোরে জোরে পাশের বাসার হাসন বক্ত মামা উকিল সাহেব উকিল সাহেব বলে ডাকতে থাকেন। আব্বা ধড়মড়িয়ে ওঠেন, আমরাও। উনি হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, সর্বনাশ হয়েছে- যুদ্ধ লেগে গেছে। ঢাকায় পাকিস্তানিরা আমাদের আক্রমণ করেছে। আব্বা প্রশ্ন করেন, জানলেন কীভাবে? উনি শুধু বলেন খবর সত্য। আব্বা রেডিও ছাড়তে যান। কিন্তু সকালের আগে ঢাকার রেডিও খুলবে না। ফজরের আজান পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে যান। দেখা যায় সবাই রাস্তায়। ভোরেই নানাভাই চলে আসেন তার চলনদার আবু ভাইসহ। সকালে সালেহর আব্বা আলফাত মামা আসেন আর আব্বাসহ বেরিয়ে যান। হোসেন বক্ত মামাকে চরকির মতো রিকশায় ঘুরতে দেখি সকালে। একটু বেলা হলে মানুষজন রাস্তা থেকে চলে যেতে থাকে।
দুপুরের দিকে দাদা বাসায় আসেন। কালো প্যান্ট কালো জাম্পার গায়ে পেছনে রাইফেল। রাস্তায় নেক ভাইসাব রাইফেল হাতে। ওসি সাহেব আর আনসারের হেড নাকি সব তাদের দিয়েছে যুদ্ধ করার জন্য। দাদা আম্মাকে আর আব্বাকে সালাম করতে আসছেন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। পাকের ঘরে জলচৌকিতে খাইতে দেন আম্মা। আমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দাদা আম্মাকে বলেন 'কে যে কোথায় যাবেন ঠিক নাই। আমার সঙ্গে আর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নাই। বাবুকে দেখে রাখবেন। উনি অসুস্থ। ভালো করে একটা দৌড়ও দিতে পারবেন না। উনার জন্যেই আমার চিন্তা।' আম্মা শুধু অঝোর ধারায় কাঁদতেই থাকেন। আমরাও কাঁদতে থাকি। কালো জাম্পার গায়ে রাইফেল কাঁধে দাদা বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন, আজও চোখে ভাসে। দাদাকে এই শেষ দেখি। আর দেখি স্বাধীন বাংলাদেশে। ২৭ মার্চ রাতে এক গাড়ি ভর্তি আর্মি আসে। এসডিও সাহেবের সঙ্গে দেখা করে কারফিউ জারি করে সার্কিট হাউসে যায় আর সেই ফাঁকে ছাত্র-জনতা সার্কিট হাউস ঘেরাও করে ফেলে। আব্বা রাস্তায়, আমিও রাস্তায়। কারফিউ ভেঙে সবাই রাস্তায় জমায়েত হয়। কোত্থেকে মিছিল শুরু হয় জানি না। ছোট্ট মিছিল কয়েকটা রাস্তা ঘুরে চলে আসে। দুপুরের দিকে শুরু হয় যুদ্ধ। আম্মা-মতিউর মামা আর দাদার জন্য কান্না শুরু করেন। হাছন বক্ত মামা বলেন, বড়রা নিরাপদে আছে। ছাত্রদের খবর তিনি জানেন না। উনি আমাদের বাসায় থাকা অবস্থায় ঝড় শুরু হয়। সামনে অপেক্ষা করে আরও বড় যুদ্ধ।

সাবেক জেলা ও দায়রা জজ; সদস্য, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×