'ভাস্কর্য' বিতর্ক
দেশের শত্রুরা দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছে
আবদুল মান্নান
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০
দেশের শত্রুরা দরজায় কড়া নাড়ছে। না, কোনো ব্যক্তিবিশেষের দরজায় না; বাঙালি জাতির দরজায়। এই শত্রু একবার ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কড়া নেড়েছিল। জাতি সে সময় সঠিকভাবে সাড়া দেয়নি। কারণ তারা প্রস্তুত ছিল না। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর ক্ষমতা দখলকারী পরবর্তী সময়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতির দরজাটাকে সম্পূর্ণরূপে খুলে দিয়েছিল। সেই দরজা দিয়ে বাঙালির সব শত্রু, যাদের দেশের মানুষ জামায়াত-শিবির বা স্বাধীনতাবিরোধী বলে জানে তারা সদলবলে প্রবেশ করে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত দেশটাকে ধ্বংস করার কাজে লেগে পড়েছিল। বকিটা ইতিহাস। সেই বাংলাদেশ এখন অনেকটা মিনি পাকিস্তানে রূপ নিচ্ছে। মাঝখানে খালেদা জিয়া এই তস্করদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আরও বলবান করছেন। এখন তারা অনেকটা বেপরোয়া; যার একটা উৎকৃষ্ট প্রমাণ সম্প্রতি লালনের শহর কুষ্টিয়ায় নির্মিতব্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যকে রাতের অন্ধকারে ভেঙে ফেলার মতো ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। ঘটনাটি শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার নয়। এটি বাংলাদেশের হৃদয়ে আঘাত। বাংলা নামের দেশটার মূলে কুঠারাঘাত। এ জন্য কারা দায়ী তা বের করতে রাত জেগে গবেষণা করার প্রয়োজন নেই। এরা যে এমন কাজ করবে, তা আগেই ঘোষণা করেছে। এরা কোনো কিছু লুকিয়ে করে না। কারণ তাদের পেছনে অনেক বড় রাজনৈতিক শক্তি ক্রিয়াশীল। তারা দেশের ভেতর থেকে মদদ পায়, ইন্ধন আসে দেশের বাইরে থেকেও।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত, তা নিয়ে একটা তত্ত্ব আছে। পরিসংখ্যান বলে, সাড়ে ১৬ কোটি। বাস্তবে দশ কোটি। বাকি সাড়ে ছয় কোটি হচ্ছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে রেখে যাওয়া পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত পাকিস্তানি নাগরিক, যাদের সংখ্যা এখন বৃদ্ধি পেয়ে সাড়ে ছয় কোটিতে দাঁড়িয়েছে। এদের আদি পিতা ছিলেন জামায়াত নেতা গোলাম আযম। বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার সময় নিজ দেশ পাকিস্তানে ছিলেন। জেনারেল জিয়া তাকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এদেশে নিয়ে এসেছিলেন। ছিলেন বহাল তবিয়তে। নিজের দল জামায়াতে ইসলামকে পুনর্গঠিত করেছেন; সরকারের বিভিন্ন পদে পদায়ন করেছেন। নিজের ছেলেকে সেনাবাহিনীতে অফিসার হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। আর তাকে এসব ব্যাপারে সার্বিক সহায়তা করেছেন জেনারেল জিয়া। জিয়ার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রাষ্ট্রের হাল ধরে এসব পাকিস্তানিকে নিজের মন্ত্রিসভার সদস্য বা উপদেষ্টা করেছেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করেছেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এসব পাকিস্তানি বেশ আরামেই ছিলেন। চারদিকে তাদের রমরমা অবস্থা। বাদ সাধল ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরলে বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারের মুখোমুখি করা হয় গোলাম আযম গংয়ের। প্রকাশ্য আদালতে শুনানির পর তাদের হয় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু তারা তো হাতেগোনা কয়েকজন। অন্য সবাই রয়ে যায়। তারা এখন কথা বলছে। দরজায় কড়া নাড়ছে।
একাত্তরে যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করেছিল; আলবদর বাহিনী গঠন করে আমাদের স্বাধীনতাকামী মানুষ ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল, তারা এখন অর্থবিত্ত, ক্ষমতা আর নানামুখী দাপটের কারণে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী। বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে লাই পেয়ে তারা সরকারের রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ প্রবেশ করেছে। আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠনেও ঢুকেছে কাতারে কাতারে। সব সরকারের আমলে তারা ফায়দা লুটেছে। তারা যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে- তারা তা দেখিয়েছে ২০১৩ সালের ৫ মে যখন তারা রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে শাপলা চত্বর দখল করে দিনভর তাণ্ডব চালিয়েছে। তাদের প্রকাশ্যে মদদ জুগিয়েছেন খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি। এরশাদের জাতীয় পার্টি তাদের পানি পান করিয়েছে। তারা বলেছে, সরকারের ঘোষিত নারী নীতির বিরুদ্ধে তারা জিহাদ ঘোষণা করেছে, যা তাদের ভাষায় ইসলামবিরোধী। অথচ ইসলামে নারীকে যতটা স্বাধীনতা দিয়েছে, তা অন্য ধর্মে কখনও দেয়নি। সেদিন শাপলা চত্বর দখলের নেতৃত্ব দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি ধর্মাশ্রিত সংগঠন। নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান মওলানা শফী। সারাদিন এই তথাকথিত মুফতি, পীর আর আল্লামারা হুংকার ছেড়েই চলেছিলেন। খেলাফতের মামুনুল হক, চরমোনাই পীর রেজাউল করীম, ইসলামী আন্দোলনের ফজলুল করীম, হেফাজতে ইসলামের জুনায়েদ বাবুনগরী প্রমুখ, কেউ বাদ যাননি। তারা স্বপ্ন দেখেছিলেন- সেদিনই সরকারের পতন অনিবার্য। বিএনপি তো বলেই দিয়েছিল- 'আজ রাত আপনাদের শেষ রাত'। পরদিন তারা বিজয়ের বেশে বঙ্গভবন আর গণভবন দখল করে সরকার গঠন করছে। এরা সবাই ছিল পাকিস্তানের রেখে যাওয়াদের উত্তসূরি। বাদ সাধল সরকার স্বয়ং। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সন্ধ্যায় ঘোষণা করলেন- দ্রুততম সময়ে যদি এই ধর্ম ব্যবসায়ীরা শাপলা চত্বর না ছাড়ে, তাহলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। শাপলা চত্বরে তখন আগুন জ্বলছে, সারা দুনিয়ার মানুষ দেখছে। মধ্যরাতের কিছু পর সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অ্যাকশন শুরু হয়েছিল। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে প্রায় বিনা রক্তপাতে দখলদার তস্করদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছিল রাজধানী।
বঙ্গবন্ধুকন্যা সব সময় সংঘাত এড়িয়ে চলেছেন। খালেদা জিয়া যখন দেশে প্যাট্রোল বোমা সন্ত্রাস শুরু করেছেন, তখন তিনি শান্তির হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। খালেদা জিয়া তাকে সরকারের দুর্বলতা মনে করে সন্ত্রাসের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অপমানিত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। পরবর্তী সময়ে হেফাজতের মাওলানা শফীকে গণভবনে ডেকে তাদের সঙ্গে শেখ হাসিনা কথা বলেছেন। তাদের কওমি মাদ্রাসার দেওয়া ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আইন করেছেন। কিন্তু এসব ধর্ম ব্যবসায়ী শেখ হাসিনার পদক্ষেপকে তার দুর্বলতা মনে করেছেন। এরই মধ্যে মাওলানা শফীর মৃত্যু হলে হেফাজতের একাংশের মতে, ক্ষমতার লোভে হেফাজতের বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ মাওলানা শফীকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে তাকে হত্যা করেছে। এসবের মাঝখানে বাবুনগরী নিজেকে হেফাজতের আমির ঘোষণা করেছেন; আর সঙ্গে রেখেছেন খেলাফতের মামুনুল হককে। পদ-পদবি পেয়েই তারা এবার হুংকার ছেড়েছেন- বিভিন্ন স্থানে নির্মিতব্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেবেন। এটা এক চূড়ান্ত বেয়াদবি রাষ্ট্রের সঙ্গে। তাও এই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে, বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে। ঔদ্ধত্যের একটা সীমা থাকা উচিত। এর আগে বিভিন্ন সময়ে সুযোগ পেলে তারা দেশের পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন। তারা একযোগে নিজেদের দেশের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করেন। তাদের উস্কানিতে ইতোমধ্যে কুষ্টিয়া সদরে পৌরসভা কর্তৃক নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য যারা ভেঙেছে, তাদের পরিচয় জানা গেছে। তারা স্থানীয় মাদ্রাসার দুই ছাত্র। অভিযোগ আছে, তাদের মদদ দিয়েছেন মাদ্রাসার দুই শিক্ষক। বাবুনগরী, চরের পীর আর মামুনুল হকরা মনে করেন, কয়েক বছর মাদ্রাসায় পড়ালেখা করলেই বুঝি মুফতি বা আল্লামা হওয়া যায়। আল্লামা শব্দটির অর্থ হচ্ছে জ্ঞানী। বাংলাদেশে যেসব ধর্ম ব্যবসায়ী নিজেদের আল্লামা বলে দাবি করেন, তারা সবাই ইসলামের খণ্ডিত ব্যখ্যা উপস্থাপন করে ধর্মপরায়ণ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। দশম শতক থেকে শুরু করে আল্লামা ছিলেন আল ফারাবি, ইবনে খালদুন, ইমামা গাজ্জালি, ইবনে সিনা, আবু হায়তাম, জালাল উদ্দিন রুমী, ওমর খৈয়ম আর আল বেরুনির মতো জ্ঞনতাপসরা, যাদের কথা এই মামুনুল হকরা খুব কমই জানেন বা জানতে চান। তাদের ক'জন পড়েছেন কবি ও দার্শনিক আল্লামা ইকবালের জীবন ও কর্ম? তাদের পঠিত বিষয় হচ্ছে মূলত হিংসা ও বিভেদ ছড়ানোর বিভিন্ন অজুহাত ও পদ্ধতি।
ভাস্কর্য প্রসঙ্গে ইতোমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। এসব বিষয় বহু আগেই মীমাংসিত সত্য। তারা বলেন, অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রে ভাস্কর্য থাকলেও বাংলাদেশে তা থাকতে পারবে না। কারণ তারা বাংলাদেশে নাকি কোরআন ও হাদিসের ইসলাম কায়েম করতে চান। তাহলে বিশ্বে ওআইসিভুক্ত যে ৫৭টি দেশ আছে, তাদের ওখানে কি কোরআন ও হাদিসভিত্তিক ইসলাম নেই? কারণ সব দেশেই তো ভাস্কর্য আছে। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলমানপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়া তো ভাস্কর্যে ভর্তি। সেখানে তো কেউ এসব ভাঙার জিগির তোলেনি। অথচ সে দেশে ৮৮ শতাংশ মানুষ মুসলমান, ১০ শতাংশ খ্রিষ্টান আর মাত্র ২ শতাংশ হিন্দু।
আসলে এই হেফাজত বলি বা খেলাফত; সবাই ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে ব্যস্ত। তাদের লক্ষ্য বর্তমান সরকারকে যারা ফেলে দিতে চায় তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা। এই ফেলে দিতে চাওয়া দলের একেকজন সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন- সামনের জানুয়ারিতে নতুন সরকার আসছে। মামুনুল হকরা তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে কি সে আলামতই প্রকাশ করছেন? এ পর্যন্ত এসব ধর্ম ব্যবসায়ী কখনও জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার কথা বলেননি। তারা এখন বলছেন, তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চান। তারা কী নিয়ে কথা বলবেন? প্রধানমন্ত্রীর কি আর কোনো কাজ নেই? তারা তো দেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। দেশের মূলে আঘাত করেছেন। তারা প্রমাণ করেছেন- তারা এ দেশে বসবাস করার সব অধিকার হারিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে। জনগণের দাবি- দ্রুততম সময়ে তাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তাদের বুঝতে হবে, রাষ্ট্রের আইনের ঊর্ধ্বে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন থাকতে পারে না। বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে। এখানে যেমন মানুষ মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনবেন, তেমনভাবে মন্দিরে পুরোহিত পূজা পরিচালনা করবেন। খ্রিষ্টান গির্জায় গিয়ে নির্ভয়ে প্রার্থনা করবেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা নির্ঝঞ্ঝাটে তাদের ধর্মাচার পালন করবেন। এসব যাদের সহ্য হয় না তারা এদেশ ছেড়ে অন্য কোনো মুসলমানপ্রধান দেশে চলে যেতে পারেন, যেখানে কোনো ভাস্কর্য নেই। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জয় হোক। বাংলা ও বাঙালির জয় হোক।
বিশ্নেষক ও গবেষক
৮ ডিসেম্বর ২০২০
- বিষয় :
- 'ভাস্কর্য' বিতর্ক