ঢাকা শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

সুশাসন

দণ্ড মওকুফে নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ

দণ্ড মওকুফে নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ

এএমএম শওকত আলী

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ মার্চ ২০২১ | ১৪:৩২

সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আলজাজিরার তথ্যচিত্র যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, তার কিছু দিক এখনও ধূম্রজালে আবদ্ধ। অন্যদিকে এ বিতর্কের বহু পূর্বেই অর্থাৎ, ২০১২ সালে উচ্চ আদালতে একটি বেঞ্চ দণ্ডিত ব্যক্তিদের নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগের বিষয়টি বৃহত্তর আঙ্গিকে বিশ্নেষণধর্মী যে সুপারিশ বা মন্তব্য করেছে, তা এখন পর্যন্ত নির্বাহী বিভাগ আমলে নেয়নি। ২০১২ সালে বিষয়টি আমলে নিয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নির্বাহী বিভাগের এ-সংক্রান্ত ক্ষমতা প্রয়োগ দেশ-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হতো না। চলমান বিতর্কে কিছু আদর্শিক বা অতি আদর্শিক মন্তব্যও পাওয়া গেছে। যেমন ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য। শাসককে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়ার জন্যই ৪০১ ধারার জন্ম। উচ্চ আদালতের ২০১২ সালের মন্তব্যেও দুটি বিষয় উত্থাপন করা হয়। এক. ৪০১ ধারার প্রদত্ত নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য বিধি বা নির্দেশিকা প্রণয়ন যা প্রতিবেশী এক দেশ করেছে। দুই. ৪০১ ধারা চিরতরে বিলুপ্ত করা। দুই নম্বরে মন্তব্য যারা করেছেন, তারা হয়তো একটি আদর্শিক বা অতি-আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এসব কথা বলেছেন। এর পেছনে একমাত্র যুক্তি হলো বিচারিক আদালতের আদেশ নির্বাহী ক্ষমতাবলে হ্রাস বা সম্পূর্ণ পাল্টানোর অর্থ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করা। তবে যে নীতি এ ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য তা হলো বিচারিক বা নির্বাহী বা সংসদের ক্ষমতা সংবিধান ও সংবিধানের ক্ষমতাবলে সৃষ্ট আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে, রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের ক্ষমতার ভারসাম্যই হবে মূল কথা। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা যায়, দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেও নির্বাহী ক্ষমতার আওতায় দণ্ড হ্রাস ও মওকুফ করা যায়। তবে কথায় কথায় অন্যান্য দেশের উদাহরণ টেনে এনে নিজ দেশের মন্দ দৃষ্টান্তকে সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা করাও সমীচীন নয়। এ ধরনের ভুল সরকারি নীতিনির্ধারকসহ অন্যরাও অনেক সময় করে থাকে। আলোচ্য ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা ত্যাগের শেষ মুহূর্তে বহু দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মুক্তি দিয়েছেন।

ট্রাম্পের এ ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগে মার্কিন গবেষক, মিডিয়া ও বিশ্নেষকরা সমালোচনা করেছেন। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, ট্রাম্পের ক্ষমতা ত্যাগের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত যেসব ব্যক্তির প্রশাসনে জানাশোনা রয়েছে, যেমন সাবেক প্রশাসনের কর্মকর্তারা, তারা অর্থের বিনিময়ে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে দণ্ড মওকুফের চেষ্টা করেছিলেন। জানা যায় যে, ক্ষমতা ত্যাগের এক দিন আগে ট্রাম্প এগারোজন দণ্ডিত ব্যক্তির দণ্ড মওকুফ করেন। কীভাবে এটা হলো তা জানার জন্য ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ভারমন্টের সিনেটর প্যাট্রিক লিহি এ বিষয়ে তথ্য জানার দাবি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনার ঠিক এক বছর পর বাংলাদেশেও এখন মিডিয়া আলজাজিরা তথ্যচিত্রের যেসব ব্যক্তি দণ্ড মওকুফের সুফল লাভ করেছেন, সে প্রক্রিয়া জানার জন্য অধিকতর তথ্য প্রকাশের দাবি করেছে এবং কিছু চাঞ্চল্যকর অকাট্য তথ্যও প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের কাঠামো যুক্তরাজ্যের অনুরূপ হলেও নির্বাহী বিভাগ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নয়। একমাত্র একটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের মিল রয়েছে। তা হলো, ওই দেশের রানী ও আমাদের রাষ্ট্রপতির নির্বাহী অঙ্গে অবস্থান। যুক্তরাজ্যের রানীকে বলা হয়, সাংবিধানিক শাসনকর্ত্রী। বাংলাদেশে সংবিধানের সংশ্নিষ্ট ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ব্যতীত অন্য সব দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। সংবিধানের ধারা ৪৯ বলে রাষ্ট্রপতি কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন বা বিরাম মঞ্জুর করার বা যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করার এখতিয়ার ও ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছে।

শাসন কাঠামো ভিন্নতর হলেও যুক্তরাষ্ট্রে দণ্ড মওকুফ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সরাসরি গ্রহণের সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী বিচারবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়টি যাচাই করার জন্য একটি আলাদা দপ্তর রয়েছে, যার নাম 'অফিস অব পারডন'। গত একশ পঁচিশ বছর ধরে এই দপ্তরটি রাষ্ট্রপতির ক্ষমা মওকুফের ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে আসছে। ট্রাম্প অবশ্য এ দপ্তরকে পাশ কাটিয়ে বেশিরভাগ দণ্ডিত ব্যক্তির দণ্ড মওকুফ করেছেন মর্মে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। হার্ভার্ড আইন স্কুলের গবেষক জ্যাক গোল্ডস্মিথের মতে, ৯৪ ব্যক্তির দণ্ড মওকুফের ক্ষেত্রে মাত্র সাতজনের আবেদন অফিস অব পারডন থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এ ধরনের আবেদনের জন্য বিধি বা নির্দেশনা থাকা জরুরি হলেও তা ব্যক্তিভেদে যথেষ্ট নয়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে করলেও দুটি মন্ত্রণালয়ের মতামত প্রথাগতভাবে জরুরি। এক. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দুই. আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়। তবে সরকারি কার্য সম্পাদন বিধির আওতাভুক্ত সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দণ্ড মওকুফ বা হ্রাস করার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। অন্যদিকে যেহেতু আইনি বিষয়ে জড়িত, সেহেতু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত গ্রহণ করে থাকে। পরবর্তী পর্যায়ে সংশ্নিষ্ট আবেদন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রেরণ করার পর প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে তার পরামর্শ লিপিবদ্ধ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর পরই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। এই হলো কাঠামো এবং প্রক্রিয়া যা বিষয়ভেদে প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে বলা যায় যে, বাংলাদেশে দণ্ডিত ব্যক্তির দণ্ড মওকুফের প্রক্রিয়ায় দুটি প্রাসঙ্গিক মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বিচার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কোনো পৃথক দপ্তর নেই। গত ১৯ তারিখের একটি ইংরেজি দৈনিকে দুই দণ্ডিত সহোদরের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাশ কাঠানোর প্রশ্নের বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে। অন্যদিকে এর এক দিন আগে একটি বাংলা দৈনিকে দণ্ড মওকুফপ্রাপ্ত দুই সহোদর অসত্য তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট গ্রহণ করেছে, সে বিষয়টিও প্রকাশ করা হয়েছে।

কারাগার থেকে কোনো দণ্ডিত অপরাধীকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে হয় উপযুক্ত আদালতের আদেশ অথবা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা-সংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে সংশ্নিষ্ট সবাইকে অবহিত করবে। শেষোক্ত বিষয়ের আদেশ সচরাচর জানা যায় না। তবে রাজনৈতিক নেতা বা কোনো প্রভাবশালী কারাবন্দি রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্ত হলে সাধারণত মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়। প্রভাবশালী ছাড়াও কোনো কারাবন্দির আত্মীয়তা সূূত্রে অন্য কোনো রাজনৈতিক বা অন্যভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে সেটিও মিডিয়ায় আলোচনা করা হয়। আইন ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে কোনো কারাবন্দিকে মুক্ত করলে যে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে শুধু ট্রাম্পের আমলে নয়, সব প্রেসিডেন্টের আমলেই নির্বাহী ক্ষমতাবলে কমবেশি দণ্ডিত ব্যক্তিকে মুক্ত করা হয়েছে। ট্রাম্পের স্বপক্ষে বলা হয়েছে যে, তিনি ১১০১১টি আবেদনকারীর মধ্যে মাত্র ২৩৭ জনের বিষয়ে কারামুক্তির আদেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ শতকরা দুই শতাংশ সুবিধাভোগী এর সুফল পেয়েছে। অন্যদিকে এ কথাও বলা হয়েছে, ট্রাম্পের সময়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অথবা তার বশংবদ কর্মকর্তা ও আইনজীবী এর সুবিধাভোগী।

এ বছরের জানুয়ারির ১৯ তারিখে লিয়াম ডয়েল নামে একজনের লেখা ডেইলি এক্সপ্রেসে প্রকাশ করা হয়েছে। এর শিরোনাম ছিল 'রানীর ক্ষমতা :রানী কি অপরাধীকে ক্ষমা করতে পারেন?' এতে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের বর্তমান রানী রাষ্ট্রপ্রধান এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রপতিদের অনুরূপ অপরাধীদের ক্ষমা করার ক্ষমতা রয়েছে। তবে এ প্রথা কিছুটা ভিন্নতর। যুক্তরাজ্যের রানীর অপরাধীদের ক্ষমা করার যে রাজকীয় ক্ষমতা, তা কালেভদ্রে প্রয়োগ করা হয় মন্ত্রীদের আদেশবলে। এ ক্ষমতা দণ্ডিত অপরাধীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়। বলা যায়, রানীর ক্ষমতা সরকারের মাধ্যমেই প্রয়োগ করা হয়। রানী কোনো নির্বাহী ক্ষমতা ইচ্ছা করলেই প্রয়োগ করতে সক্ষম নন। রাজকীয় ক্ষমা প্রদর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হলো, মরণোত্তর ক্ষমা প্রদর্শন। অ্যালান টিউরিং নামে একজন যুদ্ধকালীন সমকামিতার অভিযোগে ১৯৫২ সালে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ওই ব্যক্তি ১৯৫৪ সালে মারা যান। কারাবন্দি হিসেবে তিনি রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় খোজা হওয়ার চেষ্টা করেন। একেই মরণোত্তর ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। ওই সময়ের বিচার বিভাগের মন্ত্রীর এ সম্পর্কে উক্তি ছিল- 'এ ক্ষমা সপ্রশংস উপহার' যুক্তরাজ্যে রাজকীয় ক্ষমা ওই সব কারাবন্দি বা দণ্ডিত অপরাধীকে দেওয়া হয় যারা কারাভোগের সময় ভালো বা প্রশংসনীয় কাজ করেন।

আমাদের শাসন কাঠামো সংসদীয় গণতন্ত্র যা যুক্তরাজ্যের অনুরূপ। আমরা কি কেবল কাঠামো বা খোলস নিয়ে দেশ চালাব, না যে দর্শনের ভিত্তিতে এ কাঠামো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আমরা অর্জন করেছি, সে দর্শন যাতে রাষ্ট্রীয় সব কর্মকাণ্ডে দৃশ্যমান হয় সে চেষ্টা করব। রাষ্ট্র যেমন অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারে, তেমনি উপযুক্ত ক্ষেত্রে ক্ষমা করার বিষয়েও ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ৪০১ ধারাই এ ক্ষেত্রে মুখ্য নয়। মূল বিষয়টি হলো, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ন্যায়সংগত প্রয়োগ, যা অপরাধ দমনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

আরও পড়ুন

×