ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

আলোকিত রাজনীতিক

আলোকিত রাজনীতিক

বোরহান উদ্দিন চৌধুরী মুরাদ

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২১ | ১৪:৪৩

আমাদের জন্য আনন্দের খবর হলো, এ বছর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন। তিনি বনেদি ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। একজন দেশবরেণ্য শিল্পপতি, দেশের ব্যবসায় সংগঠনের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করার পরও নিজেকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, শিল্পপতি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। দেশ ও মানুষকে ভালোবাসতেন বিধায় নিজেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তার কর্মময় জীবনের ব্যাপ্তি বিশাল। জীবন আমার ধন্য আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মতো এত বড়মাপের মহৎ হৃদয়বান জাতীয় নেতার সাহচর্য লাভের সুযোগ হয়েছিল। তাকে নিবিড়ভাবে দেখেছি, মিশেছি; সুখ-দুঃখের সঙ্গী হয়েছি। যা কিছু শিখেছি, দেখেছি তা আমাকে অভিভূত করেছে। বিশাল হৃদয়ের অধিকারী এই জননেতা সব মানুষের বিপদ-আপদে দরদি হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসতেন; সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। দলের দুঃসময়ে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে তার সরব উপস্থিতি প্রত্যেক নেতাকর্মীর মাঝে প্রাণ সঞ্চার করত। দুর্দিনে সময়ের প্রয়োজনে তিনি কখনও নির্লিপ্ত থাকেননি।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নানা ঝড়ঝাপ্টার মাঝেও দলীয় আদর্শে ছিলেন অবিচল। শুধু রাজনীতিই নয়; ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের মাটি ও মানুষের জন্য কাজ করেছেন তিনি। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দেশের বেকারত্ব হ্রাসে সহায়তা করেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চারবার। নবম জাতীয় সংসদে তিনি ছিলেন পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৫৮ সালে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি মূল সংগঠন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। '৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়া থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।

মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তার পাথরঘাটায় জুপিটার হাউস থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর জুপিটার হাউস থেকে সাইক্লোস্টাইল করে প্রচার করা হয়। তার বাসা থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ সব জায়গায় পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ভারতে যান এবং সেখানে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি প্রথমে লন্ডন যান। সেখান থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে আমেরিকায় যান। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) হিসেবে আখতারুজ্জামান চৌধুরী ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হন এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি '৭২ সালের সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী।

স্বাধীনতার পর ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু চট্টটগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। '৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন এবং পরবর্তীকালে দল পুনর্গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি কারা-নির্যাতন ভোগ করেন। শুধু রাজনীতিই নয়; আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা। রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি পারিবারিক ও সমাজ জীবনেও আচার-আচরণে ছিলেন আলোকিত মানুষ। সামাজিক ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে তার বিচরণ ছিল রাজনীতির ঊর্ধ্বে এবং রাজনৈতিক ভেদাভেদের ওপরে। তার ব্রত ছিল মূলত মানবতাবোধে উদ্দীপ্ত। তার কাছে রাজনীতি ছিল বৃহত্তর মানবকল্যাণের মাধ্যম। মমত্ববোধ, মৈত্রী ও সমঝোতা অন্বেষণে তার প্রয়াস ছিল অক্লান্ত। সাংঘর্ষিক ও সহিংস রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল দৃঢ় অথচ নম্র ও শান্ত। তিনি বনেদি ও ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান এবং দেশের স্বনামধন্য শিল্পপতি হয়েও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে সাধারণ মানুষের রাজনীতিতে আমৃত্যু সম্পৃক্ত ছিলেন।

আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, তবুও আমাদের অন্তরে চির-জাগরূক। আজ আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তার স্মৃতি, অর্থপূর্ণ জীবন ও লালিত মূল্যবোধ। তার আদর্শকে অন্তরে ধারণ করে প্রতিনিয়ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি আধুনিক, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের পথ চলতে হবে।

আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর মতো ত্যাগী নেতার আজ বড়ই প্রয়োজন। তিনি সারাজীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করে গেছেন। তার মৃত্যুতে আওয়ামী পরিবারে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা কখনও পূরণ হবার নয়।

muradchy71@yahoo.com

আরও পড়ুন

×