ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

গণতন্ত্র

নির্বাচন কমিশনে 'পাল্টাপাল্টি'

নির্বাচন কমিশনে 'পাল্টাপাল্টি'

এ এম এম শওকত আলী

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২১ | ১৪:৪৩

সাম্প্রতিককালে নির্বাচন কমিশন নিয়ে সংবাদমাধ্যমে অনেক ধরনের সমালোচনা হয়েছে। এ কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান; যার দক্ষতা, সততা, ন্যায়নিষ্ঠতা; সর্বোপরি নিরপেক্ষতার ওপর গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ভরশীল। এসব গুণের অভাবই অপশাসনের প্রথম সোপান তৈরি করে। অতীতেও অন্যান্য ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে সুনাম ও জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন। কোনো মহল থেকে তাদের প্রতি আঙুল তুলে কোনো কথা বলা হয়নি। কিন্তু ১৯৯১ সালের পর অধিকাংশ সময়েই নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কোনো এক সময়ে নির্বাচন কমিশন জনরোষের চাপে নতুন করে পুনর্গঠন করা হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে নির্বাচনের বিষয়টি দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

অতীতে প্রায় সব মহল থেকে একটা দাবি উত্থাপিত হতো। তা হলো, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হবে। এ ধরনের দাবির পেছনে যুক্তি ছিল- কমিশন সব সময়, বিশেষ করে নির্বাচনের সময় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে। স্বীয় দায়িত্ব পালনে ভয়-ভীতির বহিরাগত প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষতা দৃশ্যমান করবে। বলা বাহুল্য, নিরপেক্ষ কর্মকাণ্ডই নির্বাচন কমিশনের শক্তির প্রধান উৎস। যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনার থেকে শুরু করে অন্যান্য কমিশনার ও কর্মকর্তা এ উৎসকে সজীব ও সচল রাখতে সক্ষম না হন, তাহলে একমাত্র আইনি ক্ষমতা দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করা যায় না। রাজনীতির ক্ষেত্রে এ বিষয়টির যে বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে, তা উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন।

জাতীয় ভোটার দিবসে একজন স্পষ্টবাদী নির্বাচন কমিশনার স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত নির্বাচন নিয়ে আত্মসমালোচনামূলক বক্তব্য দেন। এ কমিশনার অতীতেও অনেকটা একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। কমিশনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়েও তিনি ভিন্নমত লিখিতভাবে ব্যক্ত করেছেন, যা প্রায় সবারই জানা। এ নিয়ে অন্যান্য কমিশনার বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রকাশ্যে কোনো বিরূপ বা অশোভনীয় মন্তব্য করেননি। অর্থাৎ চাপা গুঞ্জন থাকলেও তা নগ্নভাবে প্রকাশ করা হয়নি। শালীনতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ছিল। কিন্তু ভোটার দিবসে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আয়োজিত সভায় ভোটের সময় নানা ত্রুটিপূর্ণ ও বেআইনি কর্মকাণ্ড রোধে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা নিয়ে যে আত্মসমালোচনা অন্তত একজন কমিশনার প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন, তা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কারণ বাংলাদেশ কেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ ধরনের দৃষ্টান্ত বিরল। আত্মসমালোচনা প্রকাশ্যে করার জন্য যে সৎসাহস প্রয়োজন, সে ধরনের ব্যক্তি সহজে পাওয়া দুস্কর। প্রকাশ্যে আত্মসমালোচনা করে সংশ্নিষ্ট কমিশনার এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

তবে এ ধরনের বক্তব্য যাদের পছন্দ হয়নি, তাদেরই একজন সংশ্নিষ্ট কমিশনারকে প্রকাশ্যে পাল্টা আক্রমণ করেন। তিনি কী বলেছেন, তার বিস্তারিত বিবরণ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। তবে এ ধরনের আক্রমণ মিডিয়ার দৃষ্টি এড়ায়নি। একটি বহুল প্রচলিত ইংরেজি দৈনিকে ৪ মার্চ এ সম্পর্কে প্রথম সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়েছে। এর শিরোনাম ছিল :'ইসির ওপর জনগণের আস্থা! একজন কমিশনারের ওপর সিইসির ব্যক্তিগত আক্রমণ'। এ সম্পাদকীয়টির মূলকথা ছিল, সংশ্নিষ্ট কমিশনার কোনো ব্যক্তি আক্রোশ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে বক্তব্য দেননি; বরং তিনি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে কথা বলেছেন। সম্পাদকীয় মন্তব্যে আরও বলা হয়, সিইসি ব্যক্তিগত পর্যায়ে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন। সিইসির উচিত ছিল, যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতির উদাহরণ সংশ্নিষ্ট কমিশনার চিহ্নিত করেছেন, তার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা সিইসি তার বক্তব্যে প্রকাশ করেননি; বরং নির্বাচন কমিশনকে অপদস্থ করার দোষে ওই কমিশনারকে দোষী হিসেবে চিহ্নিত করার জন্যই বক্তব্য দিয়েছেন। সম্পাদকীয় মন্তব্যের শেষ পর্যায়ে বলা হয়েছে, সিইসির উচিত কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা কী পর্যায়ে, তার মূল্যায়ন করা। নির্বাচনে সব মহলের অংশগ্রহণের জন্য সমতার ক্ষেত্র সৃষ্টি করার ব্যর্থতার দরুন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান থেকে যা সবাই আশা করে তা হলো, নির্বাচন পরিচালনার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কিত অব্যবস্থা দূর করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
একজন কমিশনারের আত্মসমালোচনায় কমিশন অপদস্থ হয়নি; বরং তিনি এর মাধ্যমে পরবর্তী পর্যায়ে কমিশনের কার্যক্রম যাতে যথাসম্ভব ত্রুটিহীন হয়, তা চিহ্নিত করেছেন। আর অপদস্থ হওয়ার যে ধারণা, তা বহু পূর্বেই হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, কিছুদিন আগে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিশিষ্ট নাগরিকরা বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও অন্যান্য বিষয়সহ অভিযোগ এনে রাষ্ট্রপতিকে লিখিতভাবে অনুরোধ করেছিলেন, যাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করে এর সুরাহা করা হয়। এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু তথ্যও প্রকাশ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ প্রকাশ্যে বলা হয় এবং এর বিচার দাবি করা হয়। এর ফলে কি কমিশন অপদস্থ বা অপমানিত হয়নি? যে নির্বাচন কমিশনার সাম্প্রতিককালের স্থানীয় নির্বাচনকে 'অনিয়মের মডেল' হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তিনি এর আগেও অন্যান্য নির্বাচন নিয়ে অনেকটা একই ধরনের বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। তিনি ছাড়াও সব ধরনের নির্বাচনের সময় সংবাদমাধ্যমে কমবেশি অনিয়মের চিত্র দৃশ্যমান করা হয়। এবারও তা মিডিয়া করেছে। বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার অন্যতম দুর্বলতা হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু পথভ্রষ্ট সদস্যের অনভিপ্রেত আচরণ; যা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার পথে প্রধান অন্তরায়। বলা বাহুল্য, নির্বাচনের সময় একমাত্র মাঠ পর্যায়ের বিচারক ছাড়া নির্বাচনী দায়িত্বে কর্মরত অন্য সবাই নির্বাচন কমিশনের অধীন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। এ সত্ত্বেও জনমানুষের মনে যে ধারণা বিদ্যমান তা হলো, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন খুব কমই হয়েছে, যা হাতে গোনা যায়। অতএব বলা যায়, ভোটার দিবসে সংশ্নিষ্ট কমিশনার যেসব কথা বলেছেন, তাতে জনগণের ধারণাই প্রতিফলিত হয়েছে।

সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের ৫০ বছরপূর্তি সম্পর্কিত সম্মেলনে অধ্যাপক রেহমান সোবহান যেসব মন্তব্য করছেন, তা ৫ মার্চের একটি দৈনিকে প্রকাশ করা হয়েছে। এ খবরের শিরোনাম ছিল 'কার্যকর নির্বাচন ব্যবস্থা গড়া যায়নি ৫০ বছরেও'। তার মতে, দেশে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও চারটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। ২০০৮ সালের পর যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোকে 'নন-ইলেকশন' বলা যায়, কারণ সেগুলো অংশগ্রহণমূলক ছিল না। এ মূল্যায়নের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট কমিশনারের বক্তব্য অনেকটা একই ধরনের। এ কমিশনারের বক্তব্যে ছিল- ক. ইভিএমের দরুন ভোটারের উপস্থিতি কম ছিল; খ. নির্বাচনকালীন সহিংসতা; গ. নির্বাচন কেন্দ্র দখল করা ইত্যাদি। অতীতেও সংবাদমাধ্যমে একই ধরনের অভিযোগ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু কমিশন এসব বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে এ ধরনের অনিয়ম কমিশন একটি 'নিরপেক্ষ' প্রতিষ্ঠান হিসেবে মেনে নিয়েছে। সমস্যাটা এই জায়গায়। ২০০৮ সালের পর থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। এর প্রতিকার নির্বাচন কমিশন একা হয়তো করতে পারবে না। দল-মত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক দল নিয়ে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা চিহ্নিত করার কাজ শুরু করতে পারে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

আরও পড়ুন

×