যিশুর পুনরুত্থানের গুরুত্ব

রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারী
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২১ | ১৪:৫০
মৃত্যু থেকে যিশু খ্রিষ্টের পুনরুত্থান এক অলৌকিক ও অনুপম ঘটনা। খ্রিষ্টীয় ধর্মবিশ্বাস এই ঘটনার ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। খ্রিষ্টধর্মের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার সাধু পৌলের কথায় 'খ্রিষ্ট যদি উত্থাপিত না হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তো আমাদের প্রচারও বৃথা, তোমাদের বিশ্বাসও বৃথা। আবার আমরা যে ঈশ্বরের সম্বন্ধে মিথ্যা সাক্ষী, ইহাই প্রকাশ পাইতেছে; কারণ আমরা ঈশ্বরের বিষয়েই সাক্ষ্য দিয়াছি যে, তিনি খ্রিষ্টকে উত্থাপন করিয়াছেন ... আর খ্রিষ্ট যদি উত্থাপিত না হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তোমাদের বিশ্বাস অলীক, এখনও তোমরা আপন আপন পাপে রহিয়াছ' (১ করিন্থীয় ১৫ : ১৩-১৭)। ঈশ্বর তার পুত্র খ্রিষ্টকে মৃত্যু থেকে পুনরুত্থিত করেছেন। পবিত্র বাইবেলে ঈশ্বরের নৈতিক দুটি গুণের বিশেষ উল্লেখ আছে, একটি হলো তিনি ন্যায়বান, অন্যটি তিনি প্রেমময়। ঈশ্বর ন্যায়বান, তিনি অন্যায় করেন না- তিনি পবিত্র ও ধার্মিক। পাপের দণ্ড তিনি অবশ্যই দেবেন। পাপী মানুষ যদি অনুতপ্ত হয়ে তার প্রতি নম্রতায় ফিরে আসে তার ইচ্ছাকে মাথা পেতে গ্রহণ করে, তাহলে তিনি তাকে ক্ষমা করে তাকে তার অনুগ্রহ দান করেন।
ঈশ্বর এতই পবিত্র যে, তিনি অপবিত্রতা বা পাপকে ঘৃণা করেন, ও তার প্রায়শ্চিত্ত হতেই হবে। সে প্রায়শ্চিত্ত মানুষ নিজে করতে পারে না। পাপে পতনের ফলে মানুষের সমস্ত ব্যক্তিসত্তা, তার ইচ্ছা, বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ ইত্যাদির সবকিছুই বিকৃত। তাই মানুষের নিজস্ব কোনো চেষ্টা, সাধনা, কাজ কি কীর্তি বা গুণের বলে তার প্রায়শ্চিত্ত সাধন করতে পারে না। যিশাইয় নবীর কথায়, 'আমরা তো সকলে অশুচি ব্যক্তির সদৃশ হইয়াছি, আমাদের সর্বপ্রকার ধার্মিকতা মলিন বস্ত্রের সমান; আর আমরা সকলে পত্রের ন্যায় জীর্ণ হই, আমাদের অপরাধ সকল বায়ুর ন্যায় আমাদিগকে উড়াইয়া লইয়া যায়' (যিশাইয় ৬৪ :৬)। তাই ঈশ্বরপুত্র খ্রিষ্ট মানুষ হয়ে এসেছিলেন, পাপের যন্ত্রণা ও দণ্ডকে তিনি নিজের সমস্ত অস্তিত্বে ভোগ করলেন। উদ্দেশ্য, যেন তার মাধ্যমে মানুষ পরিত্রাণ পায়। তিনি মানুষ হলেন যেন তিনি মৃত্যুবরণ করতে পারেন। পাপের 'বেতন' মৃত্যু, আর মৃত্যু না হলে পুনরুত্থানের প্রশ্ন আসে না। এ পুনরুত্থানই খ্রিষ্টবিশ্বাসীদের কেন্দ্রীয় বিশ্বাস, সমস্ত বিশ্বাস সূত্র তারই প্রতিধ্বনি। পৃথিবীর সকল খ্রিষ্টানকে একমাত্র ঐশতাত্ত্বিক নির্ভরবিন্দু ও প্রচারের সারমর্ম মৃত্যু থেকে খ্রিষ্টের পুনরুত্থান। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে খ্রিষ্টের পুনরুত্থান কীভাবে এলো? পুনরুত্থান তার ক্রুশীয় মৃত্যুর পুরস্কার। ক্রুশের নাটকে আপাত পরাজিত খ্রিষ্ট মৃত মানুষ, কিন্তু পুনরুত্থানের গৌরবে তিনি বিজয়ী বীর, শাশ্বত ঈশ্বরপুত্র। ঈশ্বরের অবতাররূপে তিনি মানুষের ইতিহাসে ও অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন। ঈশ্বর তার মধ্য দিয়ে মানুষের জন্য স্বর্গীয় প্রেমকে চূড়ান্তভাবে মূর্ত করেছেন। তার অলৌকিক জন্ম, অপমানজনক মৃত্যু ও আলোকদীপ্ত পুনরুত্থানের সকল ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত সাধন করেছেন।
পাপী মানুষের প্রতি প্রসন্নতায় ঈশ-মানব খ্রিষ্ট মৃত্যুর রাজ্যে প্রবেশ করে মৃত্যুকে জয় করলেন, কারণ মানুষের পরিত্রাণের জন্য ঈশ্বরের প্রেমের কারণেই তিনি তার বাধ্য ছিলেন। যেহেতু খ্রিষ্ট ছিলেন নিষ্পাপ, তাই মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য তার মৃত্যুই ছিল একমাত্র ঈশ্বর নিরূপিত ব্যবস্থা। খ্রিষ্ট আমাদের জন্য অভিশপ্ত হলেন ও ব্যবস্থার অভিশাপমুক্ত করলেন। ক্রুশীয় অপমানজনক মৃত্যু মানুষের পাপের ভয়াবহ বাস্তবতাকে তুলে ধরে। সেই বাস্তবতার কারণেই তার আত্মদান ছিল ঈশ্বরের মনঃপূত ও পবিত্র দান। তাই পুনরুত্থান তার প্রমাণ, ওই দান ও ত্যাগের কোনো ক্ষয় নেই। পাপের ভয়াবহ বাস্তবতা বুঝে খ্রিষ্টের আত্মত্যাগকে মেনে নিতে না পারলে তার পুনরুত্থানের আনন্দ লৌকিকতায়ই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। মানুষের পাপের কারণে খ্রিষ্ট প্রাণ দিলেন। খ্রিষ্টের মৃত্যুর সঙ্গে যদি আমাদের লোভ ও স্বার্থচিন্তার মৃত্যু না হয়, তাহলে তার পুনরুত্থান আমাদের কোনো নতুনত্ব এনে দিতে পারে না। বাস্তব জীবনে খ্রিষ্টের পুনরুত্থানে আমাদের সেই মূল্যবোধ ও চেতনার পুনরুত্থান হওয়ার আহ্বান আজ। মানুষ প্রকৃত মানুষ হয় তার চৈতন্য ও মূল্যবোধে। আমাদের নিত্যদিনের বাস্তবতায় সুখ-দুঃখ ও আশা-নিরাশার অভিজ্ঞতায় যিশু খ্রিষ্টের অভয়বাণী সার্থক হোক। মূল্যবোধ আবারও নতুন করে জেগে উঠুক, হোক এখন তারও পুনরুত্থান, এই প্রার্থনা করি সবার জন্য।
খ্রিষ্টীয় ঈশতত্ত্বের শিক্ষক, চার্চ পুরোহিত ও সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য