রাজধানীর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধের খবরই নেই

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২১ | ১২:০০
চার শতাব্দীর বেশি প্রাচীন নগরী ঢাকার ভাঁজে ভাঁজে কালের স্রোতে গড়ে ওঠা যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কালের গর্ভেই হারিয়ে গেছে, সেগুলো নিয়ে আক্ষেপ ছাড়া আর কিছু করার নেই। কিন্তু এখনও যেগুলো টিকে রয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণে অবহেলা ও ঔদাসীন্য নিয়ে নিছক আক্ষেপই যথেষ্ট হতে পারে না। শনিবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে- রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের তালিকাভুক্ত নিদর্শনগুলোর মধ্যেই আহসান মঞ্জিলের মতো 'পর্যটনস্থল' ছাড়া বাকিগুলো কেবল পরিচর্যাহীনতায় বিনষ্ট হওয়ার পথে। রাজধানীর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ পরিস্থিতি নিয়ে সমকালের কাছে একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ বহুল প্রচলিত বাংলা প্রবাদটি উদ্ৃব্দত করেছেন- 'সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা?' বাস্তবে পরিস্থিতি আরও করুণ। আমরা দেখছি, ওষুধেরই খবর নেই। নিদর্শনগুলো রক্ষণাবেক্ষণ দূরে থাক, সরকারি তালিকাই ক্রমে সংকুচিত হচ্ছে। আমাদের মনে আছে, ২০১৭ সালের আগস্টে খোদ প্রধানমন্ত্রী সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলোকে নিয়ে আনুষ্ঠানিক সভা করে রাজধানীর ৯৩টি স্থাপনা বা নিদর্শন সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু গত বছর সেপ্টেম্বরে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তথা রাজউক ৭৪টি স্থাপনা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।
আর সমকালকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ৩৭টি নিদর্শন তালিকাভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ, তালিকা করতে গিয়েই নিদর্শনের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে! আমরা জানি, যে কোনো নিদর্শন বা স্থাপনা সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তালিকাকরণ প্রাথমিক পদক্ষেপ মাত্র। পরবর্তী কার্যক্রম আরও সময় ও শ্রমঘন। কিন্তু রাজধানীর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, তালিকা করতে গিয়েই ক্রমে 'ক্ষয়' হয়ে যাচ্ছে। মাত্র তিন বছর আগে তালিকা করা ৯৩টি নিদর্শন থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষে 'নামিয়ে আনা' ৩৭টি শেষ পর্যন্ত সংরক্ষণ সম্ভব হবে কিনা সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা মনে করি, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর ঔদাসীন্য ও অবহেলাই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মূল কারণ। সরকারেরই বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতাও স্পষ্ট। সমকালকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাজধানীর অন্যতম প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন 'রূপলাল হাউজ' পুরোনো চেহারায় ধরে রাখতে 'কতবার যে মন্ত্রণালয়কে চিঠি' দেওয়া হয়েছে! বস্তুত একটি দপ্তরের পক্ষে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এতবার চিঠি দেওয়া সত্ত্বেও সাড়া না পাওয়ার মধ্য দিয়েই সংরক্ষণ-সংক্রান্ত চিত্র পরিস্কার হয়ে যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বহনকারী ইমারত বা স্থাপনা অপসারণ, পুনর্নির্মাণ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা সংযোজনের ক্ষেত্রে গত বছর রাজউকের পক্ষে যে 'নিষেধাজ্ঞা' জারি করা হয়েছে, তা আশার আলো দেখাতে পারত। কিন্তু নিরাশার বিষয় এই, সংস্থাটি প্রজ্ঞাপন জারি করেই দায় সেরেছে।
সমকালের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, প্রায় সব স্থাপনাই এখন ধ্বংসের মুখে। দেখার জন্য কোথাও কেউ নেই। অনেকে কারসাজি করে এসব সম্পত্তির জাল দলিলপত্রও তৈরি করে 'মালিক' বনেছেন। রাজধানীর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে জরিপ পরিচালনার যে সুপারিশ কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ করেছেন, আমরা সেটি সমর্থন করি। কিন্তু তারও আগে এখনও অবশিষ্ট ও সুপরিচিত স্থাপনাগুলো রক্ষা করতে হবে। তালিকা করতে গিয়েই আমাদের যে অভিজ্ঞতা, জরিপ চালাতে গিয়ে আরও সময়ক্ষেপণ হলে অদূর ভবিষ্যতে দু-একটি বিখ্যাত স্থাপনা ছাড়া বাকিগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা আশঙ্কা। বিভিন্ন প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত স্থাপনা যেভাবে জনসাধারণের ঘরকন্নার জন্য ব্যবহূত হচ্ছে, তাও বাড়তি বিপদের শঙ্কা জাগায়।
বস্তুত রাজউক, সিটি করপোরেশন ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রশি টানাটানি ও দায়িত্ব ঠেলাঠেলির জের ধরে পুরান ঢাকায় আমরা এর আগে কয়েকটি প্রাচীন ভবন ধসে পড়তেও দেখেছি। তাতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে বিষয়টি কেবল নিয়মের নয়, নিরাপত্তার প্রশ্নেও জরুরি। কেবল ঐতিহ্য রক্ষা নয়, অধিকারেরও প্রশ্ন। আমরা চাই, অবিলম্বে ত্রিমাত্রিক উদ্যোগ গৃহীত হবে- দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়, স্থাপনাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ এবং পূর্ণাঙ্গ জরিপ ও তালিকা করা। রাজধানীর প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে এরই মধ্যে যথেষ্ট বিলম্ব হয়েছে, আর কালক্ষেপণের অবকাশ নেই।
- বিষয় :
- রাজধানী
- প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
- সম্পাদকীয়