মানবসম্পদ
মানবিক নেতৃত্বের মাধ্যমেই মহামারি মোকাবিলা

সাক্সি হান্দা
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২১ | ১২:০০
'স্তম্ভিত'- এই একটি শব্দই সম্ভবত বর্তমান সময় এবং আমাদের মানসিক অবস্থাকে জুতসইভাবে তুলে ধরতে পারে। বিপর্যস্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন এবং সকালে ঘুম ভাঙতেই উদ্বিগ্ন করে তোলার মতো নানান খবরাখবর প্রতিনিয়তই আমাদের স্তম্ভিত করে দিচ্ছে।
আমাদের চারপাশে একটি চাপা উৎকণ্ঠা ক্রমশ প্রখর হয়ে উঠছে। দীর্ঘমেয়াদি এই নিঃসঙ্গতা ও বিষাদ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে যে কতটা সংকটাপন্ন করে তুলছে তা এখনই পুরোপুরিভাবে পরিমাপ করা সম্ভবও নয়। তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, এই পরিস্থিতিতে ১৮ থেকে ২৪ বছরের (মিলেনিয়াল) তরুণ-তরুণীরা মানসিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই সময় এসেছে, এদেশের কর্মজীবীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার, যেটি বহু বছর ধরে আমাদের সমাজে অত্যন্ত অবহেলিত একটি বিষয়।
ইউনিলিভারে এটা অনুধাবন করেছি যে, আমরা একটি অস্বাভাবিক সময় পার করছি। এখন আমাদের কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। পরম সহমর্মিতা ও আস্থা তৈরির মাধ্যমে পারস্পরিক সহানুভূতিশীলতা তৈরি এবং অনিশ্চয়তা ও ক্ষত থেকে জয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
এই মহামারির সময়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর জীবন-জীবিকা রক্ষার তাগিদে যুগান্তকারী নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে। এই পদক্ষেপের অভিজ্ঞতাই আমাদের মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ থেকে বাঁচার সুরক্ষা বেষ্টনী তৈরিতে সহায়তা করছে। এই লেখাটিতে সেগুলোরই কিছু দিক তুলে ধরার প্রচেষ্টা রইলো।
কর্মীরাই সবার আগে
আমরা সব সময় বিশ্বাস করি যে, কর্মীদের প্রতি যত্নশীল হলে তারাও যত্নের সঙ্গে ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই আমরা আমাদের কার্যক্রমের প্রতিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অবকাঠামো তৈরি থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা পর্যন্ত প্রতিটি কাজ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সম্পন্ন করেছি। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ইউনিলিভার বাংলাদেশে বাইপ্যাপ মেশিন, করোনা টেস্টিং কিট, হাই নজেল ক্যানোলা নিয়ে এসেছে। এগুলো একদিকে আমাদের কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যেমন ব্যবহূত হয়েছে, তেমনি করোনা চিকিৎসা প্রদানকারী বিভিন্ন হাসপাতালেও বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমরা হোম টেস্টিং, হোম নার্সিংসহ ২৪/৭ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছি।
এসব পদক্ষেপ আমাদের ব্যবসায়ের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত তৃতীয় পক্ষের ২০ হাজার কর্মীকেও এই সুরক্ষা বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে এসেছি। মহামারির এই এক বছরের প্রতিটি দিন আমরা শুরু করেছি প্রত্যেক কর্মীর স্বাস্থ্যের খোঁজ দিয়ে এবং যার যেমন সহযোগিতা প্রয়োজন, তাকে সেভাবে সহযোগিতা পৌঁছে দিতে পেরেছি।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, আমাদের কাজ কেবল শারীরিক স্বাস্থ্য দেখভালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং কর্মীদের প্রত্যেকের মানসিক স্বাস্থ্যকে জোরালো রাখার জন্য অভিজ্ঞ একদল মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন।
টেকসই ও বাসযোগ্য সমাজ
এই মহামারির শুরুতে যখন কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি জানা ছিল না, তখন থেকেই সাবান ছিল এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর একটি হাতিয়ার। আমরা যেহেতু সাবান ও হান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, প্রথম থেকেই আমাদের চেষ্টা ছিল- অতিপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের জোগান এমনভাবে নিশ্চিত রাখা, যাতে বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ এসব পণ্যের মাধ্যমে নিজেকে এবং পরিবারের প্রিয়জনদের সুরক্ষিত রাখতে পারে। তবে মহামারিকালে পণ্যের জোগান ঠিক রাখার কাজটি কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। তারপরও আমাদের কারখানা ও মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সামনের সারির কর্মী বাহিনীর দৃঢ় প্রত্যয় ও অসীম মনোবলের কারণেই এই অসম্ভব কাজটি করা সম্ভব হয়েছে। সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ, পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ এবং যথাযথ বিশ্রাম নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নজর রেখেছি।
গতি ও তৎপরতা
করোনা মহামারি আমাদের জীবনে প্রথম যে প্রভাবটি ফেলেছে তা হলো- এটি আমাদের নিত্যদিনের স্বাভাবিক নিয়ম-নীতিগুলোকে অনেকখানিই ভেঙে দিয়েছে। এক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতিতে কাজ করাকে দ্রুত আয়ত্তে আনার জন্য প্রযুক্তি কাঠামোর যতটা প্রয়োজন ছিল, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল কাজের নতুন পদ্ধতিকে আত্মস্থ করার মানসিক প্রস্তুতি। তবে, মহামারির আগ থেকেই এ বিষয়ে ইউনিলিভারের পূর্ব অভিজ্ঞতা ও নতুন পদ্ধতিতে কাজ করার প্রস্তুতি থাকায় আমাদের জন্য বিষয়টি কিছুটা হলেও সহজ হয়েছে। মহামারির কারণে একদিকে অনেক ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন যেমন অনেকখানি বেড়ে গেছে, তেমনি কিছু কাজের চাহিদা কমেও গেছে। ইউনিলিভারের বৈশ্বিক টুল-ফ্লেক্স কাজে লাগানোর মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ তার নিজের বিশেষ দক্ষতাটি কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করতে পারছে। আমাদের কর্মীরাও দেশে বসে অন্য দেশের প্রজেক্টে কাজ করতে পারছে।
যোগাযোগ ও শিখনের মাধ্যমে কর্মীসংযোগ
আমরা যারা কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত রয়েছি, কর্মক্ষেত্রটি তাদের জন্য বাড়ির মতোই ভালোবাসার একটি জায়গা। এর মধ্যেই গত বছরের মার্চ মাসে হঠাৎ সে জীবনের ছন্দপতন হলো এবং আমরা আমাদের বাসস্থানকেই কর্মস্থানে পরিণত করতে বাধ্য হলাম। আমরা বুঝতে পারলাম যে, ভার্চুয়াল এই জগতেই এখন থেকে বেশি বেশি যোগাযোগ করার উপলক্ষ তৈরি করতে হবে। আমরা আরও আবিস্কার করলাম যে, এই কঠিন সময়ে নতুন নতুন বিষয়ে শেখার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেগুলো আমাদের ঘরবন্দি জীবনের একঘেয়েমি ভাবকে কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি নতুন করে আশাবাদী করে তুলছে। তাই বিশ্বব্যাপী ইউনিলিভার শেখাকে উদ্বুদ্ধ করতে চালু করলো লার্নিং উইক অ্যান্ড প্রোগ্রাম। চলমান করোনা মহামারির মাঝেও বাংলাদেশের সকল কর্মী সব থেকে বেশি সংখ্যক ঘণ্টা শেখার জন্য ব্যবহার করে বিশ্বে এক নম্বর দেশ হিসেবে ইউনিলিভারে স্বীকৃতি পেয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রবিন্দুতে
মহামারির মধ্যে আমরা যখন আমাদের কর্মীদের সঙ্গে যতই যোগাযোগ করছিলাম, ততোই বুঝতে পারছিলাম যে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বেশ গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের প্রত্যেক কর্মী যেন একটি খুদে বার্তা/ফোন কল/ এক ক্লিকেই আমাদের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে পারে, সে লক্ষ্যে আমরা '২৪/৭ এমপ্লয় অ্যাসিসট্যান্স' প্রোগ্রাম চালু করি। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমাদের কর্মীরা যেকোনো সময়ে তাদের মধ্যে যে কোনো আশঙ্কা বা মানসিক চাপ সৃষ্টির বিষয়ে জানানো বা আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছে। যদিও এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ হেল্পলাইন আমাদের আগেও ছিল। তবে এই মহামারিতে এই হেল্পলাইনের ব্যবহার প্রায় ১০৬ শতাংশ বেড়েছে, যা আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে যে, অস্বাভাবিক এই সময়ে মানসিক সহযোগিতা একজন কর্মীর জন্য কতখানি জরুরি একটি বিষয়। কর্মীদের মাঝে আমরা 'মানসিক স্বাস্থ্য চ্যাম্পিয়ন' তৈরি করেছি, যারা যেকোনো বিষয়ে নিরপেক্ষ শুনানিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং কঠিন সময়ে সহকর্মীদের মানসিক সহযোগিতা প্রদানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বৈশ্বিক এই মহামারি বিলীন কবে হবে এবং কবে আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব, তা কেউই বলতে পারছে না। আমরাও মনেপ্রাণে চাই যে, আমাদের কর্মীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকুক। সেজন্য আমাদের দায়িত্বও অনেক। গবেষণায় দেখা গেছে, সহমর্মিতার সঙ্গে নেতৃত্ব তিন গুণ বেশি প্রভাবিত করে যেকোনো কর্মী দল ও তাদের কর্মক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। তাই আমরা আমাদের ম্যানেজারদের প্রশিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ করছি, যাতে তারা সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা ও অকৃত্রিম যত্নের সঙ্গে নেতৃত্ব প্রদান করে। মহামারির দিনে আমাদের সব থেকে বড় শিক্ষা হলো- সামাজিক দূরত্বের এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে প্রয়োজন গভীর ও অর্থবহ সামাজিক যোগসূত্র। এটি নিশ্চিত করার জন্যই এখন প্রয়োজন মানবিক নেতৃত্বের।
মানবসম্পদ বিষয়ক পরিচালক, ইউনিলিভার বাংলাদেশ
আমাদের চারপাশে একটি চাপা উৎকণ্ঠা ক্রমশ প্রখর হয়ে উঠছে। দীর্ঘমেয়াদি এই নিঃসঙ্গতা ও বিষাদ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে যে কতটা সংকটাপন্ন করে তুলছে তা এখনই পুরোপুরিভাবে পরিমাপ করা সম্ভবও নয়। তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, এই পরিস্থিতিতে ১৮ থেকে ২৪ বছরের (মিলেনিয়াল) তরুণ-তরুণীরা মানসিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই সময় এসেছে, এদেশের কর্মজীবীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার, যেটি বহু বছর ধরে আমাদের সমাজে অত্যন্ত অবহেলিত একটি বিষয়।
ইউনিলিভারে এটা অনুধাবন করেছি যে, আমরা একটি অস্বাভাবিক সময় পার করছি। এখন আমাদের কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। পরম সহমর্মিতা ও আস্থা তৈরির মাধ্যমে পারস্পরিক সহানুভূতিশীলতা তৈরি এবং অনিশ্চয়তা ও ক্ষত থেকে জয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
এই মহামারির সময়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর জীবন-জীবিকা রক্ষার তাগিদে যুগান্তকারী নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছে। এই পদক্ষেপের অভিজ্ঞতাই আমাদের মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ থেকে বাঁচার সুরক্ষা বেষ্টনী তৈরিতে সহায়তা করছে। এই লেখাটিতে সেগুলোরই কিছু দিক তুলে ধরার প্রচেষ্টা রইলো।
কর্মীরাই সবার আগে
আমরা সব সময় বিশ্বাস করি যে, কর্মীদের প্রতি যত্নশীল হলে তারাও যত্নের সঙ্গে ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই আমরা আমাদের কার্যক্রমের প্রতিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অবকাঠামো তৈরি থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা পর্যন্ত প্রতিটি কাজ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে সম্পন্ন করেছি। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ইউনিলিভার বাংলাদেশে বাইপ্যাপ মেশিন, করোনা টেস্টিং কিট, হাই নজেল ক্যানোলা নিয়ে এসেছে। এগুলো একদিকে আমাদের কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যেমন ব্যবহূত হয়েছে, তেমনি করোনা চিকিৎসা প্রদানকারী বিভিন্ন হাসপাতালেও বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমরা হোম টেস্টিং, হোম নার্সিংসহ ২৪/৭ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছি।
এসব পদক্ষেপ আমাদের ব্যবসায়ের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত তৃতীয় পক্ষের ২০ হাজার কর্মীকেও এই সুরক্ষা বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে এসেছি। মহামারির এই এক বছরের প্রতিটি দিন আমরা শুরু করেছি প্রত্যেক কর্মীর স্বাস্থ্যের খোঁজ দিয়ে এবং যার যেমন সহযোগিতা প্রয়োজন, তাকে সেভাবে সহযোগিতা পৌঁছে দিতে পেরেছি।
এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, আমাদের কাজ কেবল শারীরিক স্বাস্থ্য দেখভালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং কর্মীদের প্রত্যেকের মানসিক স্বাস্থ্যকে জোরালো রাখার জন্য অভিজ্ঞ একদল মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন।
টেকসই ও বাসযোগ্য সমাজ
এই মহামারির শুরুতে যখন কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি জানা ছিল না, তখন থেকেই সাবান ছিল এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর একটি হাতিয়ার। আমরা যেহেতু সাবান ও হান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, প্রথম থেকেই আমাদের চেষ্টা ছিল- অতিপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের জোগান এমনভাবে নিশ্চিত রাখা, যাতে বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষ এসব পণ্যের মাধ্যমে নিজেকে এবং পরিবারের প্রিয়জনদের সুরক্ষিত রাখতে পারে। তবে মহামারিকালে পণ্যের জোগান ঠিক রাখার কাজটি কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। তারপরও আমাদের কারখানা ও মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সামনের সারির কর্মী বাহিনীর দৃঢ় প্রত্যয় ও অসীম মনোবলের কারণেই এই অসম্ভব কাজটি করা সম্ভব হয়েছে। সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ, পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ এবং যথাযথ বিশ্রাম নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নজর রেখেছি।
গতি ও তৎপরতা
করোনা মহামারি আমাদের জীবনে প্রথম যে প্রভাবটি ফেলেছে তা হলো- এটি আমাদের নিত্যদিনের স্বাভাবিক নিয়ম-নীতিগুলোকে অনেকখানিই ভেঙে দিয়েছে। এক্ষেত্রে নতুন পদ্ধতিতে কাজ করাকে দ্রুত আয়ত্তে আনার জন্য প্রযুক্তি কাঠামোর যতটা প্রয়োজন ছিল, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল কাজের নতুন পদ্ধতিকে আত্মস্থ করার মানসিক প্রস্তুতি। তবে, মহামারির আগ থেকেই এ বিষয়ে ইউনিলিভারের পূর্ব অভিজ্ঞতা ও নতুন পদ্ধতিতে কাজ করার প্রস্তুতি থাকায় আমাদের জন্য বিষয়টি কিছুটা হলেও সহজ হয়েছে। মহামারির কারণে একদিকে অনেক ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন যেমন অনেকখানি বেড়ে গেছে, তেমনি কিছু কাজের চাহিদা কমেও গেছে। ইউনিলিভারের বৈশ্বিক টুল-ফ্লেক্স কাজে লাগানোর মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ তার নিজের বিশেষ দক্ষতাটি কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করতে পারছে। আমাদের কর্মীরাও দেশে বসে অন্য দেশের প্রজেক্টে কাজ করতে পারছে।
যোগাযোগ ও শিখনের মাধ্যমে কর্মীসংযোগ
আমরা যারা কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত রয়েছি, কর্মক্ষেত্রটি তাদের জন্য বাড়ির মতোই ভালোবাসার একটি জায়গা। এর মধ্যেই গত বছরের মার্চ মাসে হঠাৎ সে জীবনের ছন্দপতন হলো এবং আমরা আমাদের বাসস্থানকেই কর্মস্থানে পরিণত করতে বাধ্য হলাম। আমরা বুঝতে পারলাম যে, ভার্চুয়াল এই জগতেই এখন থেকে বেশি বেশি যোগাযোগ করার উপলক্ষ তৈরি করতে হবে। আমরা আরও আবিস্কার করলাম যে, এই কঠিন সময়ে নতুন নতুন বিষয়ে শেখার যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেগুলো আমাদের ঘরবন্দি জীবনের একঘেয়েমি ভাবকে কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি নতুন করে আশাবাদী করে তুলছে। তাই বিশ্বব্যাপী ইউনিলিভার শেখাকে উদ্বুদ্ধ করতে চালু করলো লার্নিং উইক অ্যান্ড প্রোগ্রাম। চলমান করোনা মহামারির মাঝেও বাংলাদেশের সকল কর্মী সব থেকে বেশি সংখ্যক ঘণ্টা শেখার জন্য ব্যবহার করে বিশ্বে এক নম্বর দেশ হিসেবে ইউনিলিভারে স্বীকৃতি পেয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রবিন্দুতে
মহামারির মধ্যে আমরা যখন আমাদের কর্মীদের সঙ্গে যতই যোগাযোগ করছিলাম, ততোই বুঝতে পারছিলাম যে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বেশ গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের প্রত্যেক কর্মী যেন একটি খুদে বার্তা/ফোন কল/ এক ক্লিকেই আমাদের কাছে দ্রুত পৌঁছাতে পারে, সে লক্ষ্যে আমরা '২৪/৭ এমপ্লয় অ্যাসিসট্যান্স' প্রোগ্রাম চালু করি। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমাদের কর্মীরা যেকোনো সময়ে তাদের মধ্যে যে কোনো আশঙ্কা বা মানসিক চাপ সৃষ্টির বিষয়ে জানানো বা আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছে। যদিও এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ হেল্পলাইন আমাদের আগেও ছিল। তবে এই মহামারিতে এই হেল্পলাইনের ব্যবহার প্রায় ১০৬ শতাংশ বেড়েছে, যা আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে যে, অস্বাভাবিক এই সময়ে মানসিক সহযোগিতা একজন কর্মীর জন্য কতখানি জরুরি একটি বিষয়। কর্মীদের মাঝে আমরা 'মানসিক স্বাস্থ্য চ্যাম্পিয়ন' তৈরি করেছি, যারা যেকোনো বিষয়ে নিরপেক্ষ শুনানিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং কঠিন সময়ে সহকর্মীদের মানসিক সহযোগিতা প্রদানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
বৈশ্বিক এই মহামারি বিলীন কবে হবে এবং কবে আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব, তা কেউই বলতে পারছে না। আমরাও মনেপ্রাণে চাই যে, আমাদের কর্মীরা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকুক। সেজন্য আমাদের দায়িত্বও অনেক। গবেষণায় দেখা গেছে, সহমর্মিতার সঙ্গে নেতৃত্ব তিন গুণ বেশি প্রভাবিত করে যেকোনো কর্মী দল ও তাদের কর্মক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। তাই আমরা আমাদের ম্যানেজারদের প্রশিক্ষিত ও উদ্বুদ্ধ করছি, যাতে তারা সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা ও অকৃত্রিম যত্নের সঙ্গে নেতৃত্ব প্রদান করে। মহামারির দিনে আমাদের সব থেকে বড় শিক্ষা হলো- সামাজিক দূরত্বের এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে প্রয়োজন গভীর ও অর্থবহ সামাজিক যোগসূত্র। এটি নিশ্চিত করার জন্যই এখন প্রয়োজন মানবিক নেতৃত্বের।
মানবসম্পদ বিষয়ক পরিচালক, ইউনিলিভার বাংলাদেশ
- বিষয় :
- মানবসম্পদ