ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ

করোনাকালে জীবন-জীবিকার বাজেট

করোনাকালে জীবন-জীবিকার বাজেট

ড. মুনাজ আহমেদ নূর

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২১ | ১২:০০

করোনা মহামারির মাঝেই ঘোষিত হতে যাচ্ছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট। করোনাকালের দ্বিতীয় বাজেট এটি। চলতি বছরের ৩ জুন জাতীয় সংসদে এই বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটের আকার হতে পারে ছয় লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা; যা চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। গতবারের মতো এবারও করোনা মোকাবিলা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাজেটের সারসংক্ষেপ দেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাজেট বাস্তবায়নের ওপরও জোর দিয়েছেন।
করোনা মহামারির চলমান সময়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের বাজেটে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামঞ্জস্যতার নিরিখে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে করোনা মোকাবিলা। আগামী এক-দুই বছর আমাদের দেশে করোনা মোকাবিলা সবচেয়ে জরুরি খাত হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে সবার আগে করোনার বিস্তার রোধে মনোযোগ দিতে হবে। এ জন্য টিকা দেওয়ার বিকল্প নেই। আগামী অর্থবছরে দেশের সব নাগরিককে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সে জন্য টিকা কেনা, দেওয়া, সংরক্ষণ, টিকাদানকারীদের প্রশিক্ষণসহ এই বিশাল কর্মযজ্ঞে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ আগামী বাজেটে রাখতে হবে।
গুরুত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষায়। বর্তমানে আমাদের চিকিৎসকের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। যথেষ্ট ঘাটতি আছে দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীর। আগামী অর্থবছরে এ খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিয়ে এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে। করোনায় কেউ যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যান সে জন্য মাস্টারপ্ল্যানের আলোকে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোকে অত্যাধুনিক করা ও সেখানে আইসিইউ ও ভেন্টিলেটর সরঞ্জাম বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তবে এ মাস্টারপ্ল্যান যেন ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করতে হবে যেন তার মাধ্যমে জনগণ উপকৃত হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবাকে আরও গতিশীল করতে আগামী বছরের বাজেটে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ এবং তাদের জন্য প্রণোদনা, ঝুঁকি ও সম্মানী ভাতা বাবদ ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে; যা এ খাতকে গতিশীল করবে বলে আমার বিশ্বাস।
করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন রক্ষা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে জীবিকার ওপর আঘাত এসেছে। ২০০৫ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ। ২০২১ সালে এই হার ২১ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু এখন করোনার অতিমারির কারণে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরও প্রকট করে তুলেছে। তাই দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে আগামী বছরের বাজেটে বেশ কিছু কর্মসূচি রাখা আবশ্যক বলে মনে করছি।
অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, এই বাজেটের মাধ্যমে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে গরিবদের এই অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে আসা। যারা অতিরিক্ত গরিব, তাদের গরিব পর্যায়ে এবং যারা গরিব তাদের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু যদি এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে হয় তাহলে তাদের কর্মসংস্থানের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় তা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। বাজেটে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও বিশেষ নজর দিতে হবে। কৃষি খাতেও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশে খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ও আত্মনির্ভরশীলতা বাড়াতে কৃষিতে ভর্তুকি বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষিঋণে সুদের হার কমাতে হবে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোকে সুসংহত করতে হবে। বীজ, সার, কৃষি যন্ত্রপাতির দাম কমানোসহ কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের ওপর জোর দিতে হবে।
মানবসভ্যতা টিকে আছে শিক্ষার ওপর। শিক্ষাকে বাদ দিয়ে মানবসভ্যতার অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। করোনার অতিমারিতে যেসব খাত চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম শিক্ষা খাত। শিক্ষায় যে ক্ষতিটা হচ্ছে তা এখন সেভাবে উপলব্ধি করা যাচ্ছে না, কারণ শিক্ষা একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। যেখানে শিক্ষার যে কোনো প্রভাব ১০ থেকে ১২ বছর পরে পড়ে। করোনার কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিগত ১৫ মাস ধরে বন্ধ। এই বন্ধ আগামী ১২ জুন পর্যন্ত বর্ধিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই দীর্ঘ বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ইতোমধ্যে ঝরে পড়েছে, হয়তো অনেকে আর পড়াশোনাই করবে না। বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা এক কঠিন বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সবাইকে টিকার আওতায় না এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে সংশ্নিষ্ট সবাই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এই সেক্টরের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সেইসঙ্গে বিকল্প পাঠদান পদ্ধতি হিসেবে আমাদের ডিজিটাল প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকতে হবে। অনলাইনে পাঠদান অব্যাহত রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী কোথাও বিনামূল্যে আবার কোথাও স্বল্প সুদে ল্যাপটপ কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ব্যবস্থা করতে হবে। বিনামূল্যে ডাটার ব্যবস্থা করতে হবে; এ জন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কিংবা বরাদ্দ রাখতে হবে। শিক্ষকদের নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ বিষয়ে বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে, তা না হলে শিক্ষকরা নতুন প্রযুক্তিতে শিক্ষাদানে উৎসাহিত হবেন না।
করোনা মহামারির মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তার অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। করোনার মধ্যেও প্রবৃদ্ধি অর্জনে যে কয়েকটি দেশ এগিয়ে আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অন্যান্য দেশ যখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে খাবি খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে এই হার ৫.২৪ শতাংশ। আর আগামী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। অন্যদিকে আগামী বাজেটে মূল্যস্টম্ফীতি ধরা হচ্ছে ৫.৩ শতাংশ। এখন বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ২২৭ ডলার, যা বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
যে কোনো প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ তার জীবন ও জীবিকা রক্ষার তাগিদে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী লড়াই করে থাকে। মানুষের এ লড়াই মৃত্যু, শোক, জরা কিংবা তাপের মধ্যেও থেমে থাকে না। সাম্প্রতিক সময়ে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক অতিমারি বা মহামারির বিপর্যস্ত বাস্তবতায় আমরা যার যার অবস্থান থেকে একই সঙ্গে জীবন ও জীবিকা রক্ষায় সেই ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট রয়েছি।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সারাদেশের সাড়ে ৩৬ লাখ পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচিও অব্যাহত রয়েছে। ৬৪ জেলায় ইউনিয়ন হিসাব করে জেলা প্রশাসকদের কাছে বেশ কিছু টাকা দিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে যে কোনো জায়গায় তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে তারা যেন সেটি ব্যয় করতে পারেন এবং দুস্থদের পাশে দাঁড়াতে পারেন। এ ছাড়া সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের অনুকূলে ১০ কোটি টাকা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এই মহামারি মোকাবিলায় শিল্পী, কলাকুশলী থেকে শুরু করে মসজিদ-মাদ্রাসায়ও অনুদান দিয়েছেন তিনি।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একটি ভাষণে বলেছিলেন, 'আমাদের এমন একটা সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যে সমাজে কৃষকরা ও ক্ষুধার্ত জনগণ আবার হাসতে পারবে।' অর্থাৎ এ কৃষক, শ্রমিক, বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য গড়া- এটিই ছিল জাতির পিতার স্বপ্ন। সেটিই তিনি করতে চেয়েছিলেন। জাতির পিতার সেই আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের ক্ষুধার্ত জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। গত এক যুগে দেশ কতটা উন্নত হয়েছে, তা গত তিন বছরের বাজেট পর্যালোচনা করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন।
উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

আরও পড়ুন

×