ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫

জনশক্তি

'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'

'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'

ড. তাসনিম সিদ্দিকী

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২১ | ১২:০০

বিশ্বায়ন আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছিল। সেই বিশ্বায়ন একইভাবে এই জনগোষ্ঠীকে বড় সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ সংকট নানাভাবে নানা জায়গায় পরিলক্ষিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ সরকার শ্রম অভিবাসনে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি কভিড-১৯ এর কারণে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা নানাভাবে সংকটের মুখোমুখি। ২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু করে পরবর্তী আরও কয়েকটি মাস অভিবাসন প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ ছিল। শুধু যারা ছুটিতে এসে আটকা পড়েছিলেন এমন প্রায় পৌনে তিন লাখ মানুষ অক্টোবর মাসের পর অভিবাসনের দেশগুলোতে যেতে পেরেছিলেন। ২০২১ সালে শ্রমবাজারে আবার গতি ফিরে আসে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে ফের কয়েকটি দেশ অভিবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমানে শুধু সৌদি আরব অভিবাসন চালু রেখেছে। তবে সেখানে নতুন করে কিছু সংকট দেখা দিয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমাদের শ্রমিকদের।
সম্প্রতি সৌদি আরব থেকে সমন জারি করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, করোনার দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর ১৪ দিন অতিবাহিত করেছেন এমন শ্রমিকরা সৌদিতে যেতে পারবেন। যারা করোনার টিকা গ্রহণ করেননি তাদের সেখানে যাওয়ার পর সাত দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। এ জন্য তাদের অতিরিক্ত ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হবে। এ যেন 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'। কোয়ারেন্টাইনে থাকা বাধ্যবাধকতার বিষয়টি হয়তো রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোই জানত না। কারণ ঘোষণাটি এসেছে হঠাৎ। এ নিয়ে সংকট তৈরি হলে গত বৃহস্পতিবার সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, সৌদি প্রবাসীরা কর্মস্থলে ফিরে কোয়ারেন্টাইনে থাকার খরচের অর্ধেক বা জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা ভর্তুকি বাবদ পাবেন। এ ঘোষণার পর সৌদি প্রবাসীদের সংকটের কিছুটা সমাধান হয়েছে।
তবে কাতার, কুয়েত, ওমান, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে কর্মরত বাংলাদেশিরাও একই সংকটে পড়েছেন। বাংলাদেশে-মালয়েশিয়ার বিমান চলাচল সীমিত হয়ে পড়া এবং মালয়েশিয়া সরকারের কঠোর কোয়ারেন্টাইন শর্তের কারণে তারা ফিরতে পারছেন না। প্রবাসী কল্যাণ সচিব সম্প্রতি বলেছেন, প্রথমে শুধু সৌদিগামীদের ভর্তুকি দেওয়া হবে। বাকি দেশের কর্মীদের বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। সরকারের এ উদ্যোগ অভিবাসনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
তবে, আমরা মনে করি কোয়ারেন্টাইন বাবদ অতিরিক্ত এ ব্যয়কে 'কস্ট শেয়ারিং'-এ নিয়ে যাওয়া যায় কিনা, সে ব্যাপারে আলোচনা করা দরকার। কস্ট শেয়ারিংয়ের অর্থ- এক. যেহেতু অভিবাসনের দেশগুলোতে শ্রমিক প্রয়োজন সেহেতু তারাই এ ব্যয় কিছুটা বহন করতে পারেন কিনা, অথবা তারা পুরো খরচই বহন করতে পারেন কিনা; আমাদের দূতাবাস আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়টা সমাধান করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের রিক্রুটিং এজেন্সি এবং ওই দেশগুলোর রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো যৌথভাবে এ ব্যয় মেটাতে পারে কিনা, সে বিষয়েও আলোচনা হওয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারও কিছুটা প্রণোদনা দিতে পারে। আমাদের শ্রমিকরা নিজ খরচে অভিবাসন করেন। এমতাবস্থায় সামান্য প্রণোদনা পেলে এ অতিরিক্ত ব্যয় মেটানো তাদের জন্য সহজ হবে।
অভিবাসনের ক্ষেত্রে আরও কিছু সংকট বড় আকার ধারণ করেছে। এই সময়ে আমরা দেখেছি, অবৈধভাবে ইউরোপের পথে অভিবাসনের ক্ষেত্রে জাহাজডুবিসহ বিভিন্ন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীরা। তারা বিভিন্ন জায়গায় বন্দি থাকছেন। অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। এ ধরনের সংকট নিরসনে আমাদের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। সাধারণত অনিয়মিত অভিবাসন বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখাশোনা করে আসছে। এখানে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় খুব বেশি ভূমিকা রাখে না। তাই দুই মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
আমরা জানি, অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ইউরোপে নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের রুট ব্যবহার করে পাচার চক্র। অনেক সময় ভারত হয়ে, কখনও মিসরসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ঘুরে তাদের ইউরোপে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সকে অনেক বেশি জবাবদিহিতার ভেতর আনা দরকার। মিসর বা সোমালিয়ায় যারা যেতে চান তাদের এয়ারপোর্টেই আটকে দেওয়া উচিত। কারণ আমাদের দেশের কেউ এসব দেশে ঘুরতে যান না। এর পাশাপাশি ইতোপূর্বে যাদের ওইসব দেশ থেকে ফেরত আনা হয়েছে, তারা কোন এজেন্সির মাধ্যমে সেখানে গিয়েছিল তাদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা দরকার। বিগত সময়ে জানা গেছে, কিছু ভুঁইফোঁড় রিক্রুটিং এজেন্সি এ কাজে যুক্ত। তারা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বাংলাদেশ থেকে সুদান যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
মনে রাখা দরকার, শুধু স্থানীয় পর্যায়ের দালাল বা এজেন্টদের ধরে মানব পাচার বন্ধ করা যাবে না। এ প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হলে এর সঙ্গে জড়িত মূল হোতাদেরও আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। এটা করা গেলে ইউরোপের পথে জীবন বাজি রেখে অভিবাসনের যে অবৈধ প্রক্রিয়া চালু আছে, তার রাশ টানা কিছুটা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তারা জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে যেমন গুরুত্ব দিয়ে থাকে; একই গুরুত্ব মানব পাচার রোধে দিলে এ প্রক্রিয়া বন্ধ করা সম্ভব।
ইউরোপের দেশগুলো বিশেষত ইতালিতে শ্রমশক্তির যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সুতরাং শ্রমিকদের বৈধভাবে সেখানে যাওয়ার সুযোগ করে দিলে পাচার কম হতো। কিন্তু সেখানকার উদ্যোক্তারা স্বল্প পারিশ্রমিকে শ্রমিক পাচ্ছেন বিধায় অবৈধ পথে অভিবাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। সুতরাং, পাচার চক্রকে যেমন ধরতে হবে, তেমনি ইউরোপের এসব দেশ যাতে বৈধভাবে শ্রমশক্তি আমদানি করে সে জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
অভিবাসনের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, দালালদের পরিচয়পত্র প্রদান। ২০০১ সাল থেকে দালালদের রেগুলারাইজেশনের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সরকার বিভিন্ন সময়ে দালালদের নিষিদ্ধ করার চিন্তা করেছে। দেখা গেছে, শ্রমিক অভিবাসনের ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদিত হয় দালালদের মাধ্যমে। তাদের অনেকে ভালো সেবা দিচ্ছেন; আবার অনেকে প্রতারণাও করছেন। যদি দালাল ব্যবস্থা নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো আর মাঠ পর্যায় থেকে লোক সংগ্রহ করতে পারবে না। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী দালালদের বৈধ করার কথা বলেন। গত দেড় বছর ধরে সরকার চেষ্টাও করছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটি তার মতামতে বলেছে, প্রতিটি রিক্রুটিং এজেন্সি ২০ জন দালাল নিয়োগ দিয়ে তালিকা জমা দেবে। একটি এজেন্সিকে ৬৪ জেলা থেকে লোক সংগ্রহ করতে হয়। ২০ জন দালাল দিয়ে এ কাজ কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এতে দালালের সহযোগী তৈরি হবে। সুতরাং সরকারকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা দরকার। গ্রাম পর্যায়ে দালালদের নিবন্ধন করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় জেলা পর্যায়ের ডেমো অফিসগুলোতে তিন সদস্যের একটি করে সেল গঠন করা দরকার। এই সেল দালালদের নির্ধারিত শর্ত পূরণ সাপেক্ষে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে বলবে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্টের ভিত্তিতে যাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা জালিয়াতির অভিযোগ নেই তাদের নিবন্ধিত করবে। ডেমো অফিস নিবন্ধিতদের তালিকা প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে এবং মন্ত্রণালয়ের কাছে গোটা দেশের অন্তত ১০ হাজার দালালের তালিকা থাকবে। সেই তালিকাভুক্ত দালালদের বাইরে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো লোক সংগ্রহ করতে পারবে না। এতে রিক্রুটিং এজেন্সি এবং দালাল উভয়কেই জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসা যাবে। অভিবাসনের ক্ষেত্রে 'দালাল' সর্বনামটি পরিবর্তনও করা দরকার। তারা সেবা দিচ্ছেন। সুতরাং, তাদের সম্মান দিতে হবে। তাদের সাব-এজেন্ট বা অভিবাসনের সওদাগর এ ধরনের কোনো নাম দিয়ে ফরমাল প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা দরকার।
সৌদিতে উদ্ভূত সংকট মোকাবিলায় আলোচনা করা, ইউরোপ-আমেরিকায় মানব পাচার বন্ধ করতে তিন মন্ত্রণালয়কে একত্রে কাজ করা এবং দালালদের নিবন্ধন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো অভিবাসনের ক্ষেত্রে সময়ের দাবি।
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; চেয়ারম্যান, রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি
মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)
tsiddiqui59@gmail.com

আরও পড়ুন

×