'নতুন' মাদক
সর্বাত্মক ব্যবস্থার বিকল্প নেই

কর্মস্থল থানাতেই গায়েহলুদ অনুষ্ঠান হচ্ছে নারী পুলিশ কনস্টেবল আশার- ছবি: জিনিউজ
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২১ | ১২:০০
দেশের 'মাদক সাম্রাজ্যে' নতুন করে আলোচনায় এসেছে পুরোনো প্রপঞ্চ এলএসডি (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথালমাইড)। এই মাদক কতটা ভয়ংকর হতে পারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে তার খণ্ডিত চিত্র উঠে এসেছে। বস্তুত মর্মান্তিক এই অঘটনের কারণ অনুসন্ধানে যেসব তথ্য উঠে আসছে, তা আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। কয়েক দিন ধরে সমকালসহ অন্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, হাফিজুরের আত্মহননের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপের সন্ধান পেয়েছেন। জানা গেছে, ভয়াবহ ক্ষতিকর মাদক এলএসডিই হাফিজুরকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। এই নতুন মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করেছে, তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাদকবিরোধী এত সামাজিক আন্দোলন সত্ত্বেও মাদকের উৎস যেমন নির্মূল করা যাচ্ছে না, ঠেকানো যাচ্ছে না এর অনুপ্রবেশও। এলএসডির বিরূপ প্রভাবে মস্তিস্কের বিকৃতি ঘটে এবং এর ফলে সেবনকারীর মধ্যে যে কোনো ধরনের আত্মঘাতী প্রবণতা উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আবার একই সঙ্গে এও লক্ষণীয়, যারা এলএসডি বিক্রিতে যুক্ত, তারাও বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী! ডিবি পুলিশের ভাষ্য, এই তরুণরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে গ্রুপ তৈরি করে গাঁজার নির্যাস মেশানো কেক ও এলএসডি বিক্রি করছিল। সম্প্রতি মোবাইল অ্যাপে গোপনে যোগাযোগ করে পার্সেলে নেদারল্যান্ডস থেকে চক্রটি এলএসডি সংগ্রহ করেছিল। এলএসডি দামি মাদকদ্রব্য। এই মাদকের প্রচলন ইউরোপ-আমেরিকায় থাকলেও দেশে এর বিস্তার এখনও তেমনভাবে ঘটেনি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশ, দেশের শীর্ষ উচ্চ দুটি বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকের ছড়াছড়ি। হাত বাড়ালেই মেলে সর্বনাশা সব ধরনের মাদক। সংগতই প্রশ্ন দাঁড়ায়- এই সম্ভাবনাময় প্রজন্মকে লক্ষ্যের কেন্দ্রে রেখে মাদক কেনাবেচার হোতারা যে অপকাণ্ডে মেতে উঠেছে, তা কি জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ডেরই নামান্তর নয়? আমরা এও জানি, মাদকের বিস্তার ঠেকাতে যাদের দায়দায়িত্ব সর্বাধিক, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু সদস্যসহ সংশ্নিষ্ট অন্য মহলেরও কেউ কেউ জড়িত। এর অনেক নজির আমাদের সামনে রয়েছে। যে কোনো গুরুতর সমস্যা যদি স্থায়ী রূপ ধারণ করে, তা হলে একপর্যায়ে এর বিরূপ প্রভাবের ছায়া খুব গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে মাদকাসক্তি তেমনই এক সমস্যা থেকে মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি করেছে। তরুণ-যুবকদের একটা বড় অংশ এই আত্মঘাতী আসক্তির শিকার। আরও উদ্বেগজনক হলো, এই জীবনবিনাশী আসক্তি এখন শুধু আর ওই বয়সীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; পূর্ণ বয়স্ক এমনকি শিশু-কিশোরসহ নারীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভয়াবহতার স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা ও এর সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির কারণে। আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই ইতোপূর্বে লিখেছি, উৎসে হাত না দিয়ে চুনোপুঁটিদের ধরে ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার নিরসন না করতে পারলে মাদকদ্রব্যের নির্মূল তো দূরের কথা, নিয়ন্ত্রণ করাই কঠিন। আমরা মনে করি, মাদকের অনুপ্রবেশের রুটগুলো সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলদের অচেনা নয়। সংশ্নিষ্ট সবার দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি জরুরি। দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতা, ব্যর্থতা, অদূরদর্শিতা একই সঙ্গে শর্ষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভূত সব মিলিয়ে যে ধ্বংসাত্মক পথরেখা সৃষ্টি করেছে, এ থেকে উত্তরণের রাস্তা বের করতেই হবে। সামাজিক, পারিবারিক, শিক্ষাজীবনে মাদকের বিস্তার ও হাফিজুরের আত্মহনন ভয়াবহ সামগ্রিক অবক্ষয়ের যে বার্তা পুনর্বার দিয়েছে, এর কঠোর নির্মোহ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। নেশার জগতে প্রবেশ সহজ, কিন্তু এর বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসা কঠিন; সেই কঠিনকে সহজ করে তুলতে আমাদের দাঁড়াতে হবে মাদকাসক্তদের পাশে। মাদক সহজেই চালান হয়ে সমাজ ও পারিবারিক ব্যবস্থায় যে অবক্ষয় ঘটিয়ে চলেছে, তাতে নিছক ভাবমূর্তি বা সামাজিক অনুশাসন রক্ষার প্রশ্নেই এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হতে হবে তা নয়; আমরা বরং বলতে চাই, মাদকদ্রব্যের নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের প্রশ্নেই বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, সব পক্ষ আন্তরিক হলে যে কোনো পথেই মাদকের অনুপ্রবেশ ও এর বিস্তার ঠেকানো সম্ভব। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সচেতন হতে হবে পরিবার ও সমাজকেও।
- বিষয় :
- 'নতুন' মাদক