মুক্তিযুদ্ধ
ঐতিহাসিক নকশালবাড়ীর অন্য এক অধ্যায়

এম. ইনায়েতুর রহিম
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর -০০০১ | ০০:০০
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার অন্তর্গত একটি এলাকা 'নকশালবাড়ী'। ওই নকশালবাড়ী এলাকা বাংলাদেশের উত্তর সীমান্ত বাংলাবান্ধা থেকে কাছে। আবার নেপাল সীমান্তেরও খুব কাছে। ভারত উপমহাদেশ তো বটেই; আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও নকশালবাড়ীর পরিচিতি ঘটে ১৯৬৭ সালের মে মাসের শেষভাগে। স্থানীয় জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে সাধারণ বর্গাচাষি, কৃষক-ভূমিহীনদের বিদ্রোহের কেন্দ্র ছিল এই নকশালবাড়ী। কমিউনিস্ট নেতা চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতালের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে 'নকশাল আন্দোলন' নামে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশেও নকশাল আন্দোলনের ঢেউ লাগে বিভিন্ন আঙ্গিকে।
১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঐতিহাসিক একটি ঘটনার সাক্ষী এই নকশালবাড়ী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে শুরু হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে সশস্ত্র যুদ্ধ। '৭১-এর ১০ এপ্রিল রচিত হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং গঠিত হয় কারারুদ্ধ বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ। '৭১-এর ১৭ এপ্রিল তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে (পরবর্তী সময়ে যার নামকরণ হয় মুজিবনগর) দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও শপথ গ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশের প্রথম সরকারের ঝঞ্ঝাময় চ্যালেঞ্জিং পথ চলা। এই সরকার বহুলভাবে পরিচিতি লাভ করে মুজিবনগর সরকার হিসেবে। সরকার গঠনের পর কোনো কোনো মহল প্রশ্ন ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করে সরকার গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে। আবার কোনো মহল থেকে দাবি করা হয়- 'যুদ্ধকালে প্রয়োজন বিপ্লবী সরকার'। আবার কারও দাবি ছিল 'সর্বদলীয় জাতীয় সরকার' কিংবা 'জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট' গঠন। সর্বোপরি খন্দকার মোশতাক আহমাদ ও তার কতিপয় সহযোগীর প্রচেষ্টা ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব নেওয়া; সরকারের প্রতি আস্থাহীনতার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। এহেন পরিস্থিতিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকারের কাছে এ ধরনের একটি বার্তা যায়থ ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধি অনেকেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠনের বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন। ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুজিবনগর সরকারের প্রতি জনপ্রতিনিধির আস্থার বিষয়টি দৃশ্যমান করা জরুরি হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে '৭১ সালের ৬ ও ৭ জুলাই নকশালবাড়ী ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) আঞ্চলিক সদর দপ্তর সংলগ্ন শালবাগানে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যের যৌথ সভা। সভায় ১৩৫ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও ২৩৯ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকটিতে উপস্থিত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমাদ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীসহ অন্য নেতৃবৃন্দ। ওই বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল- ক. বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকে অকুণ্ঠ সমর্থন এবং তার প্রতি অবিচল আস্থা রেখে স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া; খ. মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন; গ. পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ; ঘ. পাকিস্তানের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি এবং এ লক্ষ্যে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা; ঙ. বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা-নির্যাতন বন্ধে জাতিসংঘসহ বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো যাতে পাকিস্তান সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ; চ. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যবৃন্দের নিরাপত্তা যাতে কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ; ছ. যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তান সরকারকে অস্ত্র সরবরাহের নিন্দা প্রকাশ ও বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের দাবি; জ. যুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
ঐ বৈঠকে খন্দকার মোশতাক ও তার কতিপয় অনুসারী সরকারের ওপর অনাস্থা ও বিভিন্ন সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করার কারণে তিনি অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন এবং এক পর্যায়ে বৈঠক ত্যাগ করেন।
জনপ্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক ওই বৈঠকের পর স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তি সংগ্রাম নতুন গতি লাভ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকারের পূর্ণ আস্থা অর্জনে সক্ষম হয় মুজিবনগর সরকার। এলাকাটি বর্তমানে শিলিগুড়ি-বাগডোগরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিকটবর্তী। তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তার লেখা 'যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম (পৃ. ১৯৫)' বইয়ে ওই বৈঠকটি বাগডোগরায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে উল্লেখ করেছেন। বাগডোগরা, নকশালবাড়ী পঞ্চায়েত সমিতি ও কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ব্লকের অন্তর্ভুক্ত অর্থাৎ নকশালবাড়ী প্রশাসনের অধীন। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, বর্তমান পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া-বাংলাবান্ধা অঞ্চল '৭১-এর যুদ্ধের পুরোটা সময় ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীমুক্ত মুক্তাঞ্চল হিসেবে। যুদ্ধকালে ওই এলাকা সফর করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান, প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীসহ অনেকে।
ওই বৈঠকে অংশগ্রহণকারী মুজিবনগর সরকারের পশ্চিম জোন-১ এর চেয়ারম্যান এম. আব্দুর রহিম এমপিএ বৈঠকটি সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে-
'উপস্থিত এমএনএ এবং এমপিএ-দের নিয়ে নকশালবাড়ীর বিশাল শালবাগানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন মুজিবনগর সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমাদ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানীসহ অনেকে। এটিকে একটি মিনি যৌথ পার্লামেন্টও বলা যায়। এই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আমরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সদা প্রস্তুত। সর্বসম্মত রেজুলেশন গ্রহণ করে সেটা ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্টকে দেওয়া হয়। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমাদ আমাদের এই সিদ্ধান্তে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। এই সভাতেই তার ডিফারেন্স অব অপিনিয়ন এলো। খন্দকার মোশতাক প্রকাশ্যেই পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার কথা বললেন। তিনি কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব করলে সভায় উত্তেজনা দেখা দেয়। তখন রাগ করে খন্দকার মোশতাক তাৎক্ষণিক অধিবেশন ত্যাগ করেন। পরে আরও জানা গেছে, খন্দকার মোশতাক কনফেডারেশন গঠনের জন্য যুদ্ধকালেই নাকি গোপনে তার প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকজনকে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছিলেন। এই অন্তর্ঘাতকের হীনমানসিকতার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে '৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে এবং ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। আমার স্মৃতির পাতায় আজও অমলিন হয়ে আছে নকশালবাড়ীর সেই ঐতিহাসিক অধিবেশনের কথা। যেখানে সমবেত সদস্যদের অবস্থানকালে আতিথেয়তার জন্য যেসব সামগ্রী আমাদের সরবরাহ করা হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল একটি দড়ির খাটিয়া, তিনটি কম্বল, একটি মশারি, একটি পানীয় জলের বোতল ও একটি মগ। খাবার সরবরাহের দায়িত্ব ছিল বিএসএফ কর্তৃপক্ষের।
বাঙালি জাতির সেই দুর্যোগময় মূহূর্তে বিশ্বমানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেদিন সেই ঐতিহাসিক অধিবেশনে গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার উদ্যোগী হয়ে যৌথ কমান্ড বাহিনী গঠন করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করে। আমার বিশ্বাস, ভারত সরকার দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত যে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করেছিল, তা জাতি কোনোদিন ভুলবে না।' (মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর, সম্পাদক সুকুমার বিশ্বাস, প্রকাশক মাওলা ব্রাদার্স; দিনাজপুরে মুক্তিযুদ্ধ, সম্পাদনা ড. মোহাম্মদ সেলিম।)
৬ ও ৭ জুলাই ১৯৭১ নকশালবাড়ীতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের যৌথ বৈঠক স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে নতুন গতি সঞ্চার করে। জনপ্রতিনিধিদের অকুণ্ঠ সমর্থনে মুজিবনগর সরকারের আইনানুগ সরকার হিসেবে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন সরকার ও দেশের কাছে যথাযথভাবে উপস্থাপন ও প্রতিনিধিত্ব করার পথ সুগম হয়। ত্বরান্বিত হয় আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ।
বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ; সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, বাংলাদেশ