শিশুদের ইতিহাস শিক্ষায় করণীয়

আবুল কাশেম উজ্জ্বল
প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২২ | ০১:৪৪ | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২২ | ০৭:২৪
জাতীয় শিশু দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'শিশুদের দেশের প্রকৃত ইতিহাস শেখাতে হবে।' সমকালে প্রকাশিত সংবাদটি পড়ে বারবার ভাবলাম, কেন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে এমন কথা বলতে হলো। তার বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর পেছনে অনেক ইতিহাস আছে। আসলে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবাই যা জানত, সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছু বদলে গেছে। একটি গোষ্ঠী স্বাধীনতার আগে থেকেই চক্রান্তে লিপ্ত ছিল এবং ১৯৭৫ সালের ঘৃণ্য ও জঘন্য অধ্যায় তাদের স্বপ্ন পূরণের অবারিত সুযোগ তৈরি করে দেয়। এর পর স্বৈরাচার ও সামরিক শাসনের কবলে পড়ে ইতিহাস বিকৃতির ধারা অব্যাহত থাকে। '৯০-এর গণঅভ্যুত্থান আমাদের আশান্বিত করলেও রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় অনেক ইস্যু কেবল তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। ফলে যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, শিশুদের পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের অধ্যায় সেভাবেই রচিত হয়েছে। ১৯৯০ থেকে ২০০৫ সাল এভাবেই চলেছে। ফলে শিশুদের পক্ষে দেশের ইতিহাস নিয়ে স্থায়ী, সঠিক ও গ্রহণযোগ্য ধারণা পাওয়া কঠিন ছিল, এমনকি শিক্ষকরাও ছিলেন বিভ্রান্তিতে। এমন অনেক শিক্ষকের কথা জানি, যারা মনের কষ্ট চেপে শিশুদের পড়াতেন। কেননা, তাদের জানা ও পাঠ্যবইয়ের বর্ণনা ভিন্ন; কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছিল বিপরীত। আমার জানা নেই, পৃথিবীর আর কোনো জাতি তাদের ইতিহাস নিয়ে এমন বৈপরীত্য প্রদর্শন করেছে কিনা। তবে এখন আশার কথা হলো, বর্তমান সরকার ২০০৮ সাল থেকে ক্ষমতায় এবং এ দল মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছে, যেখানে অগ্রনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
নিজের দেশের ইতিহাস জানা সবার জন্য জরুরি। বলা হয়, ইতিহাস হচ্ছে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে যোগসূত্র। প্রত্যেক জাতিরই ইতিহাস আছে, আছে অতীতের অনেক ঘটনা; যার মধ্য দিয়ে জাতি হিসেবে তাদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। আর আমাদের ইতিহাস তো অনেক ত্যাগ, শোষণ, বঞ্চনা আর নির্মমতার ইতিহাস। সে জন্য জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের দরবারে গর্ব অনুভব করি। আমরা রাজা-বাদশাহদের দ্বারা শাসিত হয়েছি, ইংরেজদের বিতাড়ন করেছি, ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি এবং স্বধীনতার জন্য সর্বস্ব উজাড় করে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করেছি। সেই আমরাই নিজেরা নিজেদের ইতিহাস বিকৃত করছি, রাজনৈতিক বিতর্কের পথ তৈরি করে ইতিহাসের পাতাকে বারবার কলঙ্কিত করছি। ফলে দেশের মানুষ থাকে বিভান্তিতে, শিশুরা থাকে ইতিহাসবিমুখ। অথচ প্রত্যেক মানুষের নিজের দেশের ইতিহাস জানার অধিকার আছে। এটা রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব দেশের প্রকৃত ইতিহাসের সংরক্ষণ ও প্রকাশ করা।
শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, তাই নিজের দেশের ইতিহাস জানা তাদের জন্য জরুরি। আজকের শিশু ভবিষ্যতে দেশের সেবা করবে, নেতৃত্ব দেবে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে দেশের হয়ে কথা বলবে। তাই তাদের যদি সঠিক ইতিহাস শেখানো না যায়, তাহলে তাদের কাছে উপযুক্ত সেবা ও দেশপ্রেম আশা করাও দুরূহ। শিশুদের ইতিহাস বিষয়ে সঠিক শিক্ষা দেওয়ার অনেক মাধ্যম আছে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পাঠ্যবই। গত কয়েক বছর সরকার সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শ্রেণিভিত্তিক ইতিহাসবিষয়ক অধ্যায় আছে। অতীতে নবম শ্রেণি থেকে বিভাগ আলাদা হয়ে যেত। ফলে যারা বিজ্ঞান বা ব্যবসা বিভাগে অধ্যয়ন করত, তাদের জন্য ইতিহাস জানার সুযোগ অষ্টম শ্রেণিতেই থেমে যেত। তবে আশার কথা হলো, সে ধারার পরিবর্তন করা হচ্ছে। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশবিষয়ক বিষয় অধ্যয়ন করতে হচ্ছে। কিন্তু এটা কি যথেষ্ট? এখানে ভাবতে হবে, ইতিহাস জানা আর ইতিহাস ধারণ করা এক নয়।
তাই আমাদের পাঠ্যবইয়ে ইতিহাসের সঠিক বর্ণনা দেওয়ার পাশাপাশি আরও কিছু কাজ করতে হবে। কিন্তু সেটা হতে হবে নির্ভুল ও তথ্যনির্ভর। দুর্ভাগ্য যে, আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও ২০২২ সালের পাঠ্যবইও নির্ভুল নয়। আমাদের দরকার পাঠ্যবই রচনায় যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করা, যাতে ইতিহাস নিয়ে কোনো প্রকার বিকৃতি বা বিভ্রান্তি তৈরি না হয়। এ কাজে ইতিহাস বিষয়ে অভিজ্ঞদের দায়িত্ব দেওয়া, ধাপে ধাপে তা যাচাই করা এবং রচয়িতাদের উপযুক্ত সম্মানী দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা দরকার। একই সঙ্গে দরকার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে শ্রেণিভিত্তিক ইতিহাসবিষয়ক অধ্যায়ের মধ্যে ধারাবাহিকতা ও বিষয়বস্তুর কলেবর ঠিক রাখার কাজটি করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের ইতিহাস বিষয়ে পাঠদানের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানসিকতা। তাদের কেবল একটি বিষয় হিসেবে এটা গ্রহণ করলে চলবে না; বরং ইতিহাস জানার ও জানানোর আগ্রহ থাকতে হবে।
ইতিহাসের সব ঘটনা বা বিষয় শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়, দরকার ব্যবহারিক জ্ঞান। ঐতিহাসিক জাতীয় দিবসগুলোতে তাদের বাধ্যতামূলক সম্পৃক্ত করার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। জাতীয় দিবসগুলোতে বিদ্যালয়ে শিশুদের উপযোগী আলোচনা, প্রতিযোগিতা, বিতর্ক ইত্যাদির আয়োজন থাকা খুবই জরুরি। সুযোগ থাকলে স্থানীয় বা আঞ্চলিক বা জাতীয়ভাবে পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য ইতিহাসবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক বা উপযুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে শিশুদের মতবিনিময়ের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। অনেক বিদ্যালয়ে জাতীয় দিবস পালন হয়; কিন্তু সেখানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি থাকে নগণ্য, যা মোটেও কাম্য নয়। এসব আয়োজনে তাদের কেবল অংশগ্রহণকারী হিসেবে নয়, আয়োজনেও সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদের মধ্যে দেশপ্রেম ও ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়াতে হলে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই বলেই মনে করি। এসব প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের তাদের উপযোগী ইতিহাসবিষয়ক বই দেওয়ার বিধান করা যেতে পারে। এ জন্য ইতিহাসবিষয়ক শিশুতোষ বই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে রচনা করা দরকার। শিক্ষক হিসেবে দেখেছি, জাতীয় দিবসে অনেক শিক্ষার্থী শহীদ মিনারে ফুল দিতে যায় ঠিকই, কিন্তু সেটা একটা 'রুটিন ওয়ার্ক'-এর মতো করে। তাদের এ মানসিকতা বদলানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ইতিহাসবিষয়ক শিক্ষা সফরের উদ্যোগ নিতে পারে। নিজের এলাকার বা জেলার কিংবা জাতীয় সৌধগুলো পরিদর্শনের মাধ্যমে তাদের মধ্যে আগ্রহ ও চেতনা জাগ্রত করার প্রয়াস নিতে হবে। আমাদের সময় বিদ্যালয়ে সকালবেলা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো সম্মান ও আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে। এখন সে রেওয়াজ অনেকটা ম্রিয়মাণ, যা আবার চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে। ইতিহাস ও দেশপ্রেমের আবেগ তৈরি করতে হলে তাদের সেভাবেই অভ্যস্ত করতে হবে।
দেশের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে শিশুদের জন্য স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয়ভাবে নিয়মিত প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা থাকা জরুরি। এটা হতে পারে দিবসভিত্তিক বা বার্ষিক পরীক্ষার পরে। এসব প্রতিযোগিতায় তাদের জন্য বৃত্তি, সনদ ও উপযুক্ত পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের প্রিন্ট গণমাধ্যমগুলো স্থানীয় থেকে শুরু করে জাতীয়ভিত্তিক নিয়মিত প্রতিযোগিতার আযোজন করতে পারে। কিছু পত্রিকা সেটা করে, তবে তা জাতীয়ভাবে যেখানে সবার অংশগ্রহণের সুযোগও অবারিত নয়। তাই প্রতিযোগিতাগুলোকে স্থানীয় পর্যায় থেকে শুরু করা দরকার। তেমনিভাবে ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমগুলোও ইতিহাসবিষয়ক প্রতিযোগিতার সঙ্গে সঙ্গে অন্যভাবে শিশুদের ইতিহাস শিক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। কেবল দিবসভিত্তিক নয়, দরকার নিয়মিত আয়োজন। এ ক্ষেত্রে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কোনো নির্দেশনা ও নীতিমালা করা যেতে পারে, যাতে ইতিহাস নিয়ে বিকৃতির সুযোগ না থাকে।
তবে সবকিছুর ওপর দরকার রাজনৈতিক সমঝোতা ও মতৈক্য। আমরা চাই না, রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে দেশের ইতিহাস বিকৃত হোক, আর শিশুরা ভুল শিখুক।