ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

দাবদাহ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে

দাবদাহ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে

সুমন আহসানুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২২ | ০২:১০ | আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২২ | ০২:১৩

হিটওয়েভ বা দাবদাহ পরিভাষাটি বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে গত কয়েক বছরে। পত্রিকার পাতায় প্রায়ই দেখা যায় পশ্চিমা দেশগুলোর খবর। ইউরোপের ইতিহাসে অত্যুষ্ণ আটটি গ্রীষ্ফ্মের পাঁচটিই রেকর্ড করা হয়েছে গত ১০ বছরে। গত পাঁচ বছরে সাইবেরিয়ায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড ভেঙেছে দু'বার। পৃথিবীর শীতলতম মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকায় সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আফ্রিকার বহু দেশে খরা আর ধূলিঝড় বেড়েছে কয়েক গুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দাবদাহে বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১২ কোটি। 

কয়েক দশক ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে সতর্কবাণী বিশেষজ্ঞরা দিয়ে আসছিলেন, তারই বাস্তবতা এই অব্যাহত দাবদাহ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, চলতি শতকে পৃথিবীর এই উষ্ণায়ন বাড়তে থাকবে প্রতি বছরই।

দাবদাহের কারণে মানুষের এই বিপন্নতার চিত্র বাংলাদেশে ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো কারণ নেই। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এমন কোনো বছর নেই, যে বছর বাংলাদেশে দাবদাহ হয়নি। বিবিসির এক ভিডিওচিত্র বলছে, ২০০৫ সালে আট দিনের এক দাবদাহে বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজার ৭০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে দাবদাহ এবং তার প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশে তথ্য বিশ্নেষণ এবং গবেষণা নগণ্য। 

এ পর্যায়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন আর দাবদাহ বা তাপদাহ পরিভাষা ব্যাপারটা বোঝা যাক। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বা 'গেল্গাবাল ওয়ার্মিং' ব্যাপারটা মোটামুটি সবারই জানা। মানুষের দৈনন্দিন কার্যকলাপের ফলে মাত্রাতিরিক্ত কার্বনসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃস্বরণের ফলে দীর্ঘমেয়াদে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়াই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। উন্নত দেশগুলোর জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ হলেও, গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর অর্ধেক নির্গত হয় এই দেশগুলো থেকেই। এই ধারা অপরিবর্তিত থাকলে, অর্থাৎ বিজনেস এজ ইউজুয়াল চলতে থাকলে ২০৫০ সালের পর পৃথিবীর তাপমাত্রা দুই থেকে সাড়ে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু অর্থাৎ কোনো স্থানের ৩০ বছরের বেশি সময়ের আবহাওয়া তথা, বায়ু, তাপ, বৃষ্টিপাত প্রভৃতির গড় পরিবর্তন। 

আর দাবদাহ হলো স্বল্পমেয়াদে আবহাওয়ার তীব্রতা। সাধারণভাবে কোন এলাকার তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে সেটি পরপর পাঁচ দিন চলমান থাকলে তাকে দাবদাহ বা তাপদাহ বলা হয়। তবে উষ্ণতার অনুভূতি যেহেতু তাপমাত্রা ছাড়াও আর্দ্রতা এবং অন্যান্য অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে, তাই বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বা ওয়ার্ল্ড মেট্রোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের দেওয়া এই সংজ্ঞাকে বিভিন্ন দেশ নিজ নাগরিকদের খাপ খাইয়ে নেয়ার সামর্থ্য এবং বিপদাপন্নতা বিবেচনায় দাবদাহের থ্রেসহোল্ড বা মাত্রা নির্ধারণ করে নিয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ, তাপমাত্রা বেড়ে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটিকে মৃদু তাপদাহ বা হিটওয়েভ বলছে। ৩০-৪০ ডিগ্রি হলে মধ্যম, ৪০-৪২ ডিগ্রি তীব্র এবং ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে অতি তীব্র হিটওয়েভ হিসেবে বিবেচনা করে। 

২০২১-এর সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেডক্রস এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের গবেষণায় ৪৪ বছরের তাপমাত্রার বিশ্নেষণে দেখা গেছে, ঢাকায় এপ্রিল, মে ও জুন এই তিন মাস সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হয়। আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে দেশের কোথাও কোথাও বেশ গরম অনুভূত হলেও সেটা দাবদাহ বা তাপদাহ পর্যায়ে পৌঁছায় না। তবে এই ধারা বা ট্রেন্ড পরিবর্তিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক এক বিশ্নেষণে আবহাওয়া অধিদপ্তর দেখেছে যে, মধ্য মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রবণতা থাকে। গত বছর, ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি রেকর্ড করা হয়। এটি গত সিকি শতাব্দীতে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। 

প্রশ্ন হতেই পারে, বছরে পাঁচ-সাত দিন একটু বেশি গরম থাকবে, তাতে সমস্যা কোথায়? সমস্যা যে কোথায় সেটার উত্তর দেওয়ার মতো যথেষ্ট তথ্য আসলে আমাদের কাছে নেই। নেই কোনো গবেষণা। রেড ক্রিসেন্টের গবেষণা থেকে তাপদাহের কিছু স্বাস্থ্যগত প্রভাব জানা যায়। সার্বিকভাবে বাংলাদেশে, পরিবেশের তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে মানব শরীর নিজেকে ঠান্ডা রাখার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। তাই, এর বেশি তাপমাত্রা স্বাস্থ্যবান লোকের জন্য বিপজ্জনক। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে দাবদাহের সময় অন্তত বিশ শতাংশ মৃত্যু বেড়ে যায়। বাড়ে ডায়রিয়াসহ নানাবিধ রোগের প্রকোপ। 

দাবদাহে সবচেয়ে বিপদাপন্ন থাকেন বস্তিবাসী আর যারা বাইরে কাজ করেন তারা। ঘনবসতি এলাকাগুলোতে তাপ আটকে থাকে। তৈরি হয় 'হিট আইল্যান্ড'। ঢাকার বাড্ডা, গুলশান, কামরাঙ্গীরচর, বাবুবাজার, পোস্তগোলা ইত্যাদি এলাকাসহ ২৩টি এলাকাকে রেড ক্রিসেন্ট গবেষণা 'হিট আইল্যান্ড' হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব এলাকায় ২৯ থেকে ৩৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকে, যা গরম বাড়লে তাপদাহ পর্যায়ে চলে যায়। 

সামগ্রিকভাবে দাবদাহের প্রভাবে প্রান্তিক মানুষের জীবন ও জীবিকা দুই-ই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একদিকে আয় রোজগার কমে যায়, অন্যদিকে বৃদ্ধি পায় ব্যয়। বৃদ্ধি পায় স্বাস্থ্যঝুঁঁকি এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয়। শ্রমজীবী মানুষের কর্মঘণ্টা কমে যায়। ফলে আয়-রোজগার হ্রাস পায়। অন্যান্য দুর্যোগ যেমন- আগুন লাগার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত হয়। গবেষণা বলছে, দাবদাহের কারণে ঢাকার একজন শ্রমজীবী মানুষ বছরে প্রায় সোয়া তিন দিন কাজ করতে পারেন না। ৫৬ শতাংশ রিকশাচালক ২৫-৫০ শতাংশ আয় হারান। ৬৫ শতাংশ হকারের রোজগার কমে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ। প্রায় ৪১ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ এ সময় ধারকর্জ করে চলেন। ৫৮ শতাংশ ভাঙেন তাদের সঞ্চয়। 

হিটওয়েভের ফলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রভাব কেমন হয়, সে বিষয়ে কোনো গবেষণার কথা জানা যায়নি। তবে দাবদাহে কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার বা নষ্ট হওয়ার খবর প্রায়ই সংবাদপত্রে দেখা যায়। পাঁচ-সাত দিন মেয়াদি একটা বন্যা যে ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রভাব ফেলে, প্রায় একই ধরন এবং মাত্রার প্রভাব ফেলে দাবদাহ। অনেক ক্ষেত্রে তাপদাহের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা বন্যার চেয়েও বেশি হয়। কারণ এর ব্যাপ্তি থাকে দেশব্যাপী আর বন্যা হয় অঞ্চলভিত্তিক। 

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের কৃতিত্ব বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি বা বেসরকারি কোনো পর্যায়েই এখন পর্যন্ত দাবদাহকে দুর্যোগ বলে চিহ্নিত করে তার জন্য ঝুঁকি নিরূপণ ও হ্রাস করা, সচেতনতা বৃদ্ধি, মোকাবিলার পূর্বপ্রস্তুতির কোনো পরিকল্পনার কথা জানা যায়নি। 

এখন পর্যন্ত দাবদাহ হয়তো সহনীয় পর্যায়ে আছে। যদিও সব লক্ষণ-নির্দেশক বলছে, আগামী বছরগুলো হবে দুর্বিষহ। এমন যদি হয়, টানা আট-দশ দিন মাঝারি থেকে তীব্র, অতি-তীব্র দাবদাহ বয়ে যায় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে, আমরা কি জানি ক্ষয়ক্ষতির ধরন এবং ব্যাপকতা কেমন হবে? আমরা কি জানি টিকে থাকার জন্য আমাদের কী করতে হবে? উত্তর- না, জানি না। আমাদের তথ্য নেই, গবেষণা নেই, নেই পূর্বপ্রস্তুতি। 

আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত আইন, নীতি-পরিকল্পনার কোথাও তাপদাহ দুর্যোগ হিসেবে উলেল্গখিত হয়নি। শুরুটা করতে হবে এই নীতি এবং পরিকল্পনা থেকে। দাবদাহকে দুর্যোগ হিসেবে গণ্য করে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব নিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে বিপদাপন্ন মানুষের ঝুঁকি হ্রাস এবং দুর্যোগাক্রান্ত মানুষের সাহায্য পাওয়ার অধিকার।

আরও পড়ুন

×