কৃষিপণ্য বিপণন
গলির মুখে দাঁড়ানো তরমুজ

পাভেল পার্থ
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২২ | ১৩:১৬
সমকালে গত ৯ এপ্রিল 'তরমুজের লাভ কারা খায়' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, ১০ টাকা কেজি দরের তরমুজ ঢাকার রাস্তায় বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। তরমুজের ফিরিস্তি দিয়ে শুরু হলেও চলতি আলাপখানির মাধ্যমে ফসলের ন্যায্যমূল্য ও এর সামাজিক তদারকির প্রসঙ্গ আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তরমুজ ন্যায্যদামেই ক্রেতা-ভোক্তা খরিদ করতে চান; একই সঙ্গে তরমুজ চাষিও যেন তার উৎপাদনের ন্যায্যমূল্য পান। আমরা চাই না ফসল কিনে কেউ ঠকুক বা ফসলকে জিম্মি করে কেউ ঠকাতে পারে এমন ধারণা সমাজে বিদ্যমান ও প্রশ্নহীন থাকুক। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মনের গহীনে খাদ্য ও ফসল নিয়ে এমন বিপজ্জনক সন্দেহ ও প্রতারণা জিইয়ে থাকুক, তা আমরা চাই না। স্পষ্ট রাষ্ট্রীয় তৎপরতা ও সক্রিয় সামাজিক তদারকির ভেতর দিয়েই গলির মুখে দাঁড়ানো তরমুজের যাত্রাপথকে আমরা নির্বিঘ্ন করতে পারি। একটি তরমুজ কেনার মাধ্যমে কৃষক, বিক্রেতা, ক্রেতা, ভোক্তার ভেতর বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি। এর ভেতর দিয়েই নিশ্চিত হতে পারে ন্যায্য বিপণন ও মানবিক বাজার।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি তরমুজ আবাদ হয় বরিশাল বিভাগে। মোট তরমুজ আবাদের ৬৫ শতাংশই ফলে এখানে। এ ছাড়া খুলনা, সাতক্ষীরা, উত্তরাঞ্চল ও চরাঞ্চলেও তরমুজের আবাদ হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার বিভাগের তথ্য দিয়ে সমকাল জানায়, চলতি মৌসুমে ৬৭ হাজার ৯৫২ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৩ লাখ ১১ হাজার ৯৮০ টন। ২০১৯-২০ মৌসুমে ৩৮ হাজার ৮২৪ হেক্টর চমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছিল। ফলন হয়েছিল ১৪ লাখ ৫২ হাজার ৫৯২ টন। ২০১৮-১৯ মৌসুমে ৩৪,৬০৭ হেক্টর জমিতে ফলেছে ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৫৬ টন তরমুজ। ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৪৪,২৩৭ হেক্টর জমিতে ১৬ লাখ ৯১ হাজার ২০৪ টন এবং ২০১৬-১৭ মৌসুমে ৪৫,৭৪২ হেক্টর জমিতে ফলেছে ২১ লাখ ৯৫ হাজার ৯৩৯ টন তরমুজ। খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়ার প্রায় ২০টি গ্রামজুড়ে আবাদ হয় তরমুজ। প্রশ্ন উঠতে পারে- এত তরমুজ কি বিক্রি হয়? তরমুজ সুরক্ষিত রাখার কোনো মজুতকেন্দ্র বা গুদামঘরও নেই আমাদের। এমনকি তরমুজ থেকে কোনো নিরাপদ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পও গড়ে তুলিনি আমরা। খুলনার ডুমুরিয়ার কৃষক মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল তরমুজ থেকে গুড় বানিয়েছিলেন। হয়তো তরমুজ চাষ, উৎপাদন, মজুত, প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে বহু গ্রামীণ লোকায়ত কারিগরি জ্ঞান আছে। কিন্তু মূলধারার কৃষি প্রকল্প কিংবা উন্নয়নচিন্তা কৃষকের এসব লোকজ্ঞান মূল্যায়ন করে না। দূরে সরিয়ে রাখে; প্রণোদিত করে না। তো যা হয়, তরমুজ হোক বা তিল হোক চাষাবাদের যাবতীয় ঝুঁকি কৃষককেই নিতে হয়। তরমুজ বিক্রি হোক বা না হোক; বাজারে দাম থাক বা না থাক; খরা, বন্যা কি বালাইয়ে ফলন নষ্ট হলে কৃষককেই এর মূল্য দিতে হয়। আমরা যারা গপগপিয়ে রসালো তরমুজ গিলি; এই ক্রেতা-ভোক্তার জানা জরুরি, কৃষক বা কৃষির ঝুঁকি সামাল দিতে কিন্তু কখনোই তরমুজের দাম বাড়ে না। খরা বা শিলাবৃষ্টিতে জমি নষ্ট হলে তরমুজের দাম বাড়ে না। সর্বস্ব দিয়ে চাষ করে আবাদের খরচ না ওঠাতে পারা কৃষকের দুঃখ লাঘবে তরমুজের দাম বাড়ে না। যারা তরমুজ চাষ করে কিংবা যারা তরমুজ কিনে খায়; এরা কেউ তরমুজের দাম বাড়ায় না। তরমুজের দাম বাড়ায় কৃষক আর ভোক্তা বলয়ের একেবারে বাইরে থাকা এক দল নির্দয় মধ্যস্বত্বভোগী।
কোনো শস্য, ফল, ফসল ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন, নথি ও প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা কী? কোনো প্রতিষ্ঠান কৃষি ফসলের মূল্য নির্ধারণ নিয়ে কাজ করে? কৃষকের জমিন থেকে বাজার তদারকি করে? কেউ আইন ভঙ্গ করেছে কিনা, তা দেখভাল করে? কৃষক, ক্রেতা-ভোক্তা কেউ মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্য ঠকছে কিনা, তা দেখে? ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে হয়তো গরিষ্ঠভাগেরই জানা নেই, কৃষি ফসলের বিপণন বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান 'কৃষি বিপণন অধিদপ্তর'। জনগণের করের টাকায় চলা এই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ দেশের কৃষি ফসলের ন্যায্য বিপণন নিশ্চিত করা। চাইলেই কেউ ১০ টাকার তরমুজ ৫০ টাকায় বিক্রি করতে পারে না। তরমুজের মূল্য নির্ধারণ এবং ন্যায্য বিপণন নিশ্চিত করাই এই অধিদপ্তরের কাজ। কৃষি বিপণন বিষয়ে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা দৃশ্যমান না হলেও এর ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৯৩৪ সালে বিপণন বিভাগ তৈরির প্রস্তাব হয় এবং ১৯৩৫ সালে বিপণনকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে কৃষি, সমবায় ও ত্রাণ অধিদপ্তরে কৃষি বিপণন যুক্ত হয়। ১৯৬০ সালে কৃষি বিপণন পরিদপ্তরের বিভাগ, জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন 'এগ্রিকালচার প্রডিউস মার্কেট রেগুলেশন অ্যাক্ট ১৯৬৪'-এর মাধ্যমে কৃষি বিপণন নিয়ন্ত্রিত হতো। ১৯৮২ সালে কৃষি বিপণন পরিদপ্তর থেকে এটি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরে উন্নীত হয়। কিছু সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় আইন ও বিধি দ্বারা ন্যায়সংগত কৃষি বিপণন নিশ্চিত করাই এ দপ্তরের কাজ। এর ভেতর গুরুত্বপূর্ণ হলো 'কৃষি বিপণন আইন ২০১৮' এবং 'কৃষি বিপণন বিধিমালা ২০২১'। কৃষি বিপণন বিধিমালা ২০২১ অনুযায়ী রাষ্ট্র তরমুজসহ প্রায় প্রতিটি কৃষি ফসলের একটা নূ্যনতম মূল্য, যৌক্তিক মুনাফার হার ও বিপণনের বিধি ঘোষণা করেছে। তরমুজ একটি ফল এবং উৎপাদক পর্যায়ে এর যৌক্তিক মুনাফার হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ শতাংশ। পাইকারি পর্যায়ে ২০ শতাংশ এবং খুচরা পর্যায়ে ৩০ শতাংশ। রাষ্ট্রীয় এই আইনের অঙ্ক কষে সমকাল জানায়, একটি তরমুজ ২০ টাকার কাছাকাছি কেজি হতে পারে। কিন্তু কৃষকের কাছ থেকে তরমুজ বিক্রি হওয়ার পর তিন হাত ঘুরে এলাকাভেদে তরমুজের দাম ১০ গুণ দাঁড়ায়। মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা জ্বালানির মূল্য, পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়াসহ বিপণনের নানাবিধ সমস্যাকে দাম বাড়ার কারণ হিসেবে গণমাধ্যমে উল্লেখ করেছেন। তরমুজ নিয়ে এমন প্রতারণা বন্ধ হবে কবে? কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী দেশে জাতীয় কৃষি বিপণন সমন্বয় কমিটি থেকে জেলা ও উপজেলা কমিটি থাকার কথা। ঢাকার অলিগেলিতে বোঝাই তরমুজের ন্যায্য বিপণন নিশ্চিত করতে আশা করি বিপণন কমিটি সক্রিয় ও তৎপর হবে। তরমুজ বিপণনের গল্পের ভেতর দিয়েই হয়তো নতুন প্রজন্ম সত্যিকারের গণিত আয়ত্ত করবে। কৃষক, ক্রেতা-ভোক্তা ও বিক্রেতার সম্পর্ককে আন্দাজ করবে। মধ্যস্বত্বভোগী ও প্রতারণার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও নীতিকে তৎপর হতে গণআওয়াজ জোরালো করবে।
পাভেল পার্থ :লেখক ও গবেষক
- বিষয় :
- কৃষিপণ্য বিপণন
- পাভেল পার্থ