জাটকা রক্ষা কর্মসূচি: জেলেদের সুরক্ষাও জরুরি

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২২ | ১৩:১৭
জাটকা সংরক্ষণের লক্ষ্যে বরিশাল, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, শরীয়তপুর ও পটুয়াখালীতে ঘোষিত ইলিশের পাঁচটি অভয়াশ্রমে মার্চের প্রথম দিন থেকে দুই মাসের জন্য সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে; আমরা জানি। বস্তুত দেশে ইলিশ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন মেয়াদ ও মাত্রায় মৎস্য আহরণে যে নিষেধাজ্ঞা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরোপ করা হচ্ছে; কিছু সমালোচনা সত্ত্বেও তা সাধুবাদই পেয়ে এসেছে। তবে বছরে তিন দফায় অন্তত আট মাস এসব অভয়ারণ্যের নদনদী ও সমুদ্র এলাকায় যথাক্রমে মা ইলিশ, জাটকা ও সব ধরনের মাছ ধরা যদি বন্ধ থাকে; তাহলে বাকি চার মাসের 'মুক্ত' নদী ও সাগরে মাছ ধরে দেশের লাখ লাখ জেলে পরিবার কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে- সেই প্রশ্ন এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে আমরা আগেও অনেকবার তুলেছি। যত দিন যাচ্ছে; জাটকা বা ইলিশ রক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতার ঘাটতিই ক্রমে মূল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জাটকা রক্ষা করতে গিয়ে জেলেদের ওপর নির্যাতন, একমাত্র সম্বল জাল-নৌকা পুড়িয়ে ফেলা, জরিমানা, কারাদণ্ড এমনকি প্রাণহানির খবরও মিলছে। যেমন মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে শনিবার রাতে মাছ ধরতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত জেলে আমির হোসেনের স্ত্রী-সন্তানের আহাজারি ও হাহাকারের চিত্র উঠে এসেছে। নিছক পেটের দায়ে নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে ফেলা এই পরিবারকে আমরা কী সান্ত্বনা দিতে পারি?
অস্বীকার করা যাবে না- নদীতে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকা জেলেদের সাময়িক ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি রয়েছে। কিন্তু আমরা প্রায় প্রতিবছরই দেখছি, এই পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়নে গড়িমসি চলে। নিষেধাজ্ঞা শুরুর পর সপ্তাহ বা মাস পেরিয়ে গেলেও অনেক অঞ্চলে জেলেদের কাছে ত্রাণের চাল পৌঁছে না। এ বছরও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়। মঙ্গলবারই সমকালে প্রকাশিত অপর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- অভয়াশ্রম এলাকায় জেলেদের একদিকে আয়ের প্রধানতম পথ বন্ধ, অন্যদিকে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে হিমশিম খেতে হচ্ছে জেলে পরিবারগুলোকে। আবার নানা অনিয়মে অনেক জেলে পাচ্ছে না সরকারি খাদ্য সহায়তা। এমন পরিস্থিতিতে জেলেরা বাধ্য হয়ে মাছ ধরতে নদীতে নামছে। আর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করায় প্রশাসন তাদের আটক করে জেল-জরিমানা দিচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, জেলে সম্প্রদায়ের বড় অংশ দিন এনে দিন খাওয়া। নদীতে নামতে না দিয়ে আবার ত্রাণের চাল বিতরণে এক দিন বিলম্ব মানেই সংসার চলা দায়। এই বিলম্বই কাউকে যদি পেটের দায়ে নদীতে নামতে বাধ্য করে, তাহলে দোষ দেওয়া যাবে কি? এ ক্ষেত্রে ত্রাণের চাল বরাদ্দ কর্মসূচি শুরুর আগেই বিতরণ করার কথা ভাবা যেতে পারে। একই সঙ্গে লঘু পাপে গুরু দণ্ডের বিষয়টিও বিবেচনার দাবি রাখে। আর দীর্ঘমেয়াদে নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে, জেলেদের সম্পৃক্ত করে ও তাদের জীবিকা হুমকিতে না ফেলে কীভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যায়।
এও স্বীকার করতে হবে- গত দেড় দশক ধরে জোরদার এ কর্মসূচির সুফল ইতোমধ্যে স্পষ্ট। ইলিশের উৎপাদন লক্ষণীয় হারে বেড়েছে। বাড়েছে রপ্তানিও। এক দশক আগেও যে ইলিশ মধ্যবিত্তের জন্য উৎসবের উপলক্ষ ও নিম্নবিত্তের জন্য প্রায় অধরা ছিল; এখন তা সবার পাতে মিলছে অনায়াসে। স্বাভাবিকভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জেলেরাও এর সুফল পাচ্ছে। কিন্তু ইলিশ কিংবা জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি যখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খোদ জেলেদের জন্য নির্যাতনমূলক হয়ে পড়ে, তখন এ 'উন্নয়ন' নিয়ে স্বস্তিতে থাকা কঠিন। বিষয়টি কেবল মানবিকতার নয়, বরং মানবাধিকারেরও। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুলিশ ও প্রশাসনের দাপট যেমন বেশি, তেমনই জেলে সম্প্রদায় সবচেয়ে কোণঠাসা জনগোষ্ঠীগুলোর একটি। ইলিশ কিংবা জাটকা রক্ষা কর্মসূচির ডামাডোলে এই দু'পক্ষ যখন 'মুখোমুখি' দাঁড়ায়; স্বাভাবিকভাবেই জেলেদের পরিস্থিতি সবচেয়ে সঙ্গিন থাকে। আমরা বলছি না- জেলেরা নিষেধাজ্ঞা কর্মসূচি মানবে না। আমরা বরং বলতে চাই, তাদের সামাজিক অবস্থান, জীবিকার প্রয়োজন, জীবনের বাস্তবতাকে দেখতে হবে সংবেদনশীলতার সঙ্গে। কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ যখন পুলিশ ও প্রশাসন; আর কর্মসূচির 'নিশানা' যখন জেলে; তখন সবল পক্ষের সংবেদনশীলতা নিঃসন্দেহে আরও জরুরি।
- বিষয় :
- জাটকা রক্ষা কর্মসূচি