ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

সাক্ষাৎকার:বদিউল আলম মজুমদার

তিন জোটের রূপরেখায় আছে সমাধান

তিন জোটের রূপরেখায় আছে সমাধান

--

প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২২ | ১৫:২৩

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, নতুন নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। এ জন্য তাদের সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেটা সম্ভব হলে বর্তমান কমিশনের ওপর কারও অনাস্থা টিকবে না। বিএনপিও তখন এই কমিশনকে মানতে বাধ্য হবে। তবে মধ্যরাতে যারা নির্বাচন আয়োজন করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। আগামী সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- মসিউর রহমান খান


সমকাল : কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে সংলাপ করছে। জনগণের আস্থা অর্জনে আর কী পদক্ষেপ নিতে পারে?

বদিউল আলম মজুমদার: আগের দুই কমিশন কেন জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি, তা সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে। বিগত সংসদ নির্বাচনে অনেক রিটার্নিং কর্মকর্তা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে। মধ্যরাতে যারা ভোটের আয়োজন করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। ইসি সচিবালয়ের মধ্যেও সিন্ডিকেট রয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে। বিদ্যমান আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) অমান্য করে রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমানে যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো বন্ধে ইসিকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি কুমিল্লা সিটি নির্বাচনসহ সামনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জনের সুযোগ এই কমিশনের সামনে রয়েছে।

এ ছাড়া গত দুটি নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার কারণে ভোটার তালিকায় গুরুতর ত্রুটি দেখা দিয়েছে। ছবিসহ ভোটার তালিকায় শুরুতে পুরুষের তুলনায় ১৪ লাখের বেশি নারী থাকলেও বর্তমানে ভোটার তালিকায় পুরুষের সংখ্যা বেশি। ভোটার তালিকার এ ত্রুটি দূর করতে কমিশনকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে আসেনি। কারণ, অনেকের ধারণা হয়েছে, আমি গেলেও ভোট দিতে পারব না। আবার ভোট দিলেও ভোটটা সঠিকভাবে গণনা হবে কিনা, সন্দেহ আছে। নতুন কমিশন একটা সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়, এটা তাদের কার্যক্রমে প্রমাণ করতে হবে।

সমকাল : দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও তাদের মিত্ররা বর্তমান কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে রাখছে...

বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচন কমিশন যদি জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়, জনমত যদি তাদের পক্ষে চলে আসে, তখন বিএনপির এই অনাস্থা টিকবে না। অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। এখন বিরোধিতা করলেও তখন বিএনপি এই কমিশনের অধীনে নির্বাচনে আসতে বাধ্য হবে।

সমকাল : নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে। এটা সর্বদলীয় না জাতীয় সরকারের আদলে হওয়া উচিত?

বদিউল আলম মজুমদার: দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়- এটা আমাদের দেশের জন্য প্রমাণিত সত্য। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার লাগবে। তবে সেটা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে নাকি সর্বদলীয় সরকারের আদলে- সেটা রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয়। এ দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে নিরাপদ করতে রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই। অলৌকিকভাবে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন হলেই আমরা রেহাই পেয়ে যাব না। তাহলে ভবিষ্যতে আবারও এমন দুরবস্থার মধ্যে পড়তে হবে। নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখার আদলে একটা সর্বদলীয় রাজনৈতিক সমঝোতা বা জাতীয় সনদ তৈরি করতে হবে। এই সনদের মধ্যে শুধু নির্বাচন নয়, নির্বাচন-পরর্বতী সরকার গঠন নিয়েও ঐকমত্যের ভিত্তিতে ফর্মুলা থাকতে হবে। প্রথম সমঝোতা হতে হবে সুষ্ঠু নির্বাচনে সবাই সহযোগিতা করবে; এ জন্য প্রয়োজনীয় আইনকানুনের পরিবর্তনসহ সবকিছুই হবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে। দ্বিতীয় সমঝোতা হতে হবে নির্বাচন-পরবর্তী সরকার প্রক্রিয়া নিয়ে। তৃতীয় সমঝোতা হতে হবে দুর্নীতি বন্ধে ব্যাপক অভিযান পরিচালনার বিষয়ে এবং ভেঙে পড়া সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণমুক্ত করে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে।

সমকাল : এই উদ্যোগ কে নেবে বা কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব?

বদিউল আলম মজুমদার: বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা হয়তো সম্ভব মনে হচ্ছে না। কারণ, বর্তমানে যারা ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন, তারা মাঠে নেমে সরকারের কাছ থেকে কোনো দাবি আদায় করে নেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জনআকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় নিয়ে সব রাজনৈতিক দলকে একমত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, দেশে এখনই গণতন্ত্র খাদের কিনারে চলে গেছে। ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সমকাল : বিগত দুই কমিশনের আমলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে নানা সমালোচনা চলছে। আইনগতভাবে শুদ্ধ হলেও এ প্রক্রিয়া চালু রাখার বিরোধিতা জোরালো হচ্ছে...
বদিউল আলম মজুমদার: দু-চার-পাঁচটা আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়া দোষের নয়। কিন্তু গণহারে বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার প্রবণতা সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন বলে আমি মনে করি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ভোটের পরে আমি একটি মামলায় আদালতে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) হিসেবে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে।

সমকাল : ইভিএম নিয়ে কেন এই সন্দেহ?

বদিউল আলম মজুমদার: ইভিএম প্রোগ্রাম করা থাকে। প্রোগ্রাম করে ঠিক করা দেওয়া হয়, কোন মার্কার সামনের বোতাম টিপলে ভোট কোথায় যাবে। ইভিএমে ওয়ান টাইম প্রোগ্রামেবল চিপ এবং পেপার ট্রেইল সংযুক্ত করতে হবে। সবার উপস্থিতিতে ইভিএম পরীক্ষা করে সিল করে রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশনের কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান হিসেবে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর সুপারিশে পেপার ট্রেইলের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল; কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।

সমকাল : কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের বিরুদ্ধে অনাস্থার যৌক্তিকতা কতটুকু বা ইসির একার পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা কতটুকু সম্ভব?

বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইনের ৪ ধারাতে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে- স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে অনুসন্ধান কমিটি দায়িত্ব পালন করবে। এ ধারায় আরও বলা আছে, সততা ও সুনাম বিবেচনা করে তারা সুপারিশ করবে। কিন্তু সততা ও সুনামের কোনো মানদ নেই। এটার একমাত্র নির্ণায়ক হলো জনশ্রুতি, জনগণ কী মনে করে। জনগণকে আস্থায় নিয়ে কারা কার নাম প্রস্তাব করেছে, তা প্রকাশ করা হলে মানুষ মতামত দিতে পারত। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কমিশন গঠন হলে আস্থাহীনতা দূর হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতো। অনুসন্ধান কমিটি এই সন্দেহ দূর করতে ভূমিকা রাখতে পারত। নির্বাচনকালীন সরকার মানে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা যদি নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, তাহলে সবচেয়ে শক্তিশালী কমিশনও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে না। ২০১৮ সালে কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন কার্যক্রম। যেমন- গায়েবি মামলা, প্রতিপক্ষকে মাঠে থাকতে না দেওয়া ও নির্বাচনের আগে ব্যাপক সহিংসতা। অনেক প্রার্থীকে এলাকায় যেতে দেওয়া হয়নি। ইসি যদি কঠোর ব্যবস্থা নিত, তাহলে এগুলো বন্ধ করতে পারত। এরপরও যদি বেসামাল পর্যায়ে যেত, ইসি নির্বাচন স্থগিত করতে পারত। ইসি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তাদের দায়িত্ব হলো সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। ইসি হয়তো সব সময় সঠিক নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে না; কিন্তু খারাপ নির্বাচন প্রতিহত করতে পারে।

আরও পড়ুন

×