ইউক্রেন যুদ্ধ
পুতিনের মতোই ভুল বকছেন বাইডেন ও জনসন

প্যাট্রিক ককবার্ন
প্রকাশ: ১৭ মে ২০২২ | ১২:০০
আমেরিকা সম্প্রসারণবাদী জাপানকে থামাতে ১৯৪১ সালে তার আয়ত্তাধীন সব জাপানি সম্পদের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়; একই সঙ্গে জাপানে তেল সরবরাহ কমিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, এসব ব্যবস্থার একটাও কাজে আসেনি; জাপানই বরং আমেরিকার পার্ল হারবারে আকস্মিক হামলা করে বসে। যার ফলে ওই মার্কিন নৌ ঘাঁটিটি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। ওই ঘটনার ৮১ বছর পরে শত্রুর শক্তি সম্পর্কে প্রায় একই ধরনের ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন আক্রমণ করে বসেন। পুতিন ভেবেছিলেন অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রধারী তাঁর বাহিনীর সামনে ইউক্রেনীয় বাহিনী অল্প সময়ও দাঁড়াতে পারবে না; অর্থাৎ ট্রাম্প কার্ডটা তাঁর হাতেই আছে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, পুতিন ভুল হিসাব করেছিলেন, তাই তাঁকে ইউক্রেনের একটার পর একটা জায়গা থেকে পিছু হটতে হচ্ছে।
তবে পুতিনের অতি আত্মবিশ্বাসজনিত এ ব্যর্থতা থেকে ওয়াশিংটন, লন্ডন ও কিয়েভে বসে নেতারা যে ভাবছেন, মস্কোর পাল থেকে হাওয়া এখন তাঁদের পালে চলে এসেছে, এর মাধ্যমে চলমান যুদ্ধে তাঁদের বিজয় এলো বলে, তা-ও পুরোপুরি ঠিক নয়। এটা বলার কারণ হলো, বিজয় বলতে তাঁরা আসলে কী বোঝাতে চান তা এখনও স্পস্ট নয়। তাঁরা কি মনে করছেন, মস্কো ফেব্রুয়ারি-পূর্ব পরিস্থিতিতে ফিরে যাচ্ছে? অথবা তাঁরা কি এমনটা মনে করছেন, রাশিয়া ইউক্রেন থেকে পুরোপুরি সরে যাচ্ছে বা মস্কোতে শাসক পরিবর্তন ঘটতে চলেছে?
পশ্চিমা মিডিয়া ও রাজনীতিবিদরা বলে চলেছেন, ইউক্রেনে রাশিয়াকে একের পর এক অবমাননা সইতে হচ্ছে। হয়তো তাঁদের এ কথাগুলো ঠিক; তবে এগুলো ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ গতিধারা নিয়ে আমেরিকার গোয়েন্দারা চলতি সপ্তাহে যেসব প্রতিবেদন দিয়েছেন, এর সঙ্গে অনেকাংশই মেলে না। পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ও মিডিয়া পণ্ডিতরা যেখানে যুদ্ধজয়ের কথা বলছেন, সেখানে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদন আরও প্রলম্বিত এক যুদ্ধের পূর্বাভাস দিচ্ছে। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক এভরিল হাইন্স রাজনীতিবিদদের বলেছেন, পুতিন শুধু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার কথাই ভাবছেন না, ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে যে লক্ষ্য তিনি স্থির করেছিলেন তা-ও তিনি এখনও ধরে রেখেছেন; যদিও এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে তাঁকে যুদ্ধের তীব্রতা আরও বাড়াতে হবে। হাইন্স যেমনটা বলেছেন, 'ঘটনাপ্রবাহ যা বলছে তা হলো, পুতিন আরও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার দিকে ঝুঁকছেন। সংঘাত যদি চলতে থাকে অথবা পুতিন যদি বুঝতে পারেন, ইউক্রেনে তিনি হেরে যাচ্ছেন, তাহলে সামরিক শাসন কায়েমের পাশাপাশি তিনি শিল্পোৎপাদনের ধরন পাল্টে সামরিক আক্রমণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব কার্যক্রম পরিচালিত করবেন।'
মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধানরা রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খণ্ডিত হলেও বেশ আকর্ষণীয় খবর দিচ্ছেন। তাঁদের মতে, রুশ সেনাবাহিনী বা নিরাপত্তা সংস্থাগুলো যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পুতিনের কোনো সমালোচনা করছে না; তাঁরা বরং পুতিন কেন সর্বাত্মক যুদ্ধে যাচ্ছেন না, সে ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
রুশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আন্দ্রেই সলদাতভ ও ইরিনা বরোগান সম্প্রতি রুশ নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর নানা বেনামি সূত্রের বরাত দিয়ে একটা লেখা লিখেছেন। সেখানেও বলা হয়েছে, 'রাশিয়ার সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিককার লক্ষ্য থেকে সরে আসাটা ছিল একটা মারাত্মক ভুল। তাঁরা এখন মনে করেন, তাঁরা ইউক্রেন নয়, ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তাই সিনিয়র কর্মকর্তারা এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, পশ্চিমারা তাঁদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমেছেন, তাঁদেরও উচিত তেমনটা করা।'
এ কথাগুলোর মধ্য দিয়ে হয়তো রুশ এলিটদের মনোভাবটা বোঝা যায়; তবে যুদ্ধবাজ হিসেবে পুতিনের ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রতি যে তাঁদের সমর্থন আছে, এটা এখানে স্পষ্ট। এ অবস্থায় পুতিনের মারাত্মক অযোগ্যতা সত্ত্বেও তাঁর আধারাজতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটানো সহজ হবে না। তবে ক্যু অনেক সময়ই সফল হয়ে যায়। কারণ তা অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে থাকে বলে শাসকরা তা ঠেকাতে প্রস্তুতি নিতে পারেন না। এটাও মানতে হবে, এ রকম কিছু যদি আদৌ ঘটে তাহলে তা মস্কোর ক্ষমতায় পশ্চিমা সমর্থকদের বসাবে না, বসাবে তাঁদের, যারা যুদ্ধ পরিচালনায় পুতিনের চেয়েও বেশি ক্ষমতা ও দক্ষতা রাখেন।
রাশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্রটা স্বৈরতন্ত্র ও দুর্নীতির কারণে অনেকাংশেই পচে গেছে এবং এ কারণে ক্রেমলিনে যে নেতাই বসুক তাঁর পক্ষে যুদ্ধে সফলতার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা সম্ভবপর নয়। তবে এ কথা ভেবে এ সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না, ইউক্রেন জয়ের জন্য অপর্যাপ্ত দেড় লাখ সেনার জায়গায় রাশিয়া তার আট লাখ সেনাসমৃদ্ধ বিশাল সেনাবাহিনীর পুরোটা সেখানে পাঠাবে না। চলমান যুদ্ধে রাশিয়ার ব্যর্থতার একটা বড় কারণ হলো, স্থলসেনার অপর্যাপ্ততা। যাঁরা রাশিয়াকে চিরতরে দুর্বল করে দেওয়া বা সেখানে শাসক পরিবর্তনের চিন্তা করছেন, তাঁদের জন্য হাইন্সের আরেকটি কথা এখানে বলা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, 'পুতিন সম্ভবত তখনই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে অনুমতি দেবেন, যখন তিনি বুঝবেন রুশ রাষ্ট্র বা তাঁর ক্ষমতা হুমকির মুখে।' সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বামও বলেছেন, পুতিন কখনোই পরাজয় মেনে নেবেন না। তাঁরা এ কথাগুলো এমন এক সময়ে বলছেন, যখন পশ্চিমা মিডিয়া ও জনগণ ইউক্রেন প্রশ্নে তাঁদের শাসকরা যে আগের 'খুঁড়িয়ে চলা'র বদলে 'চার পায়ে লাফ দেওয়ার' নীতি গ্রহণ করতে চাচ্ছেন, সে বিষয়ে উদাসীন মনোভাব দেখাচ্ছেন। শুধু তা নয়, তাঁরা বরং অনেকাংশে তাঁদের শাসকদের ইউক্রেনে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে ওকালতি করছেন।
এক সময় যেখানে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিকে পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানোর একটা উপায় হিসেবে প্রশংসা করা হতো, এখন সেখানে একে জাদুঘরে পাঠানোর আয়োজন চলছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ডমিনিক কামিংস এ পরিবর্তনকে সূত্রায়িত করছেন। এক সময় 'আমেরিকা ও ন্যাটো রাশিয়ার ক্ষমতাকে ধ্বংস করার জন্য ইউক্রেনকে ব্যবহার করছে'- রাশিয়ার এমন কথায় কেউ কান দিলে তাকে পুতিন সমর্থক বলে গালি দেওয়া হতো। আর এখন যারা ওই নিরস্ত্রকরণ চুক্তিকে জাদুঘরে পাঠানোর বিরোধিতা করবে তাদের বলা হচ্ছে 'পুতিন সমর্থক'। কামিংস বলেছেন, ব্রিটিশ রাজনীতিতে তাঁর স্বর্ণালি অবদানের একটা হলো, 'তখন ওই পারমাণবিক ইস্যুগুলোর মতো আর কোনো ইস্যুই এতটা গুরুত্বহীনভাবে নেওয়া হয়নি।' ভয়ের ব্যাপার হলো, এ ধরনের মারাত্মক ভ্রান্তির জন্ম দেওয়া একটা সরকারই আজকে পারমাণবিক যুদ্ধ ও শান্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছে। আমেরিকা ও ন্যাটো তাদের যুদ্ধক্ষেত্র সম্প্রসারণ করতে গিয়ে ইউক্রেনের জন্য কোনো সুবিধা তৈরি করছে না, বরং দেশটাকে তারা এমন একটা যুদ্ধে জড়িয়ে দিচ্ছে যার মধ্যে ইউক্রেনের বিন্দুমাত্রও কোনো স্বার্থ নেই। ২০১১ সালে সিরিয়াকেও একই খেলায় ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, যে খেলার ফল হলো বিরামহীন যুদ্ধ এবং দেশটার অর্ধেক জনসংখ্যার উদ্বাস্তুতে রূপান্তর।
সিরিয়ায় যে রক্ত ঝরছে বাকি বিশ্ব হয়তো সেটা উপেক্ষা করতে পারে, তবে ইউক্রেন নিয়ে তারা তা করতে পারে না। কারণ, ইউক্রেন শুধু আয়তনেই একটা বড় দেশ নয়, এর ভৌগোলিক অবস্থান কৌশলগতভাবে খুব গুরত্বপূর্ণ; দেশটি বিশ্ববাসীর জন্য একটা বড় মাপের খাবার সরবরাহকারীও বটে। ন্যাটো হয়তো খুব বেশিদিন কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের বন্দরগুলোর বিরুদ্ধে রাশিয়ার দেওয়া অবরোধ সহ্য করবে না। আবার রাশিয়াও হয়তো পশ্চিম ইউক্রেনে হামলা করবে সেখান দিয়ে ইউক্রেনের জন্য পাঠানো পশ্চিমা সমরাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্য। আর এ ধরনের সামরিক হামলা-পাল্টা হামলার নিজস্ব একটা রসায়ন থাকে, যার ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই যাবে।
আজকের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনেকটা ১৯১৪ সালে মতোই, যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটেছিল। তবে আজকের খেলোয়াড়রা জানে না তারা কোন দিকে যাত্রা শুরু করেছে। কোটি কোটি মানুষের জীবন বিপর্যস্তকারী আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি আগের ওই যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দ্বিতীয় কাইজার ভিলহেলম ও দ্বিতীয় জার নিকোলাসের মতো নির্বুদ্ধি মানুষরা। কিন্তু দুর্বল জো বাইডেন ও হামবড়া বরিস জনসনের মতো নেতাদের জমানায় আমরা কি তার চেয়ে ভালো আছি?
প্যাট্রিক ককবার্ন :দি ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ও দি ইন্ডিপেন্ডেন্টের সাবেক মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদদাতা এবং 'ট্রাম্পের সময়ে যুদ্ধ'
গ্রন্থের লেখক; কাউন্টারপাঞ্চ ডট অর্গ থেকে ভাষান্তর সাইফুর রহমান তপন
- বিষয় :
- ইউক্রেন যুদ্ধ
- প্যাট্রিক ককবার্ন