ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

সমকালীন প্রসঙ্গ

জনশুমারি নিয়ে প্রশ্নগুলো সংগত

জনশুমারি নিয়ে প্রশ্নগুলো সংগত

মো. হাসিনুর রহমান খান

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২২ | ১২:০০

করোনা মহামারির অভিঘাতের ছোঁয়া থেকে বাদ যায়নি সম্প্রতি হয়ে যাওয়া জনশুমারিও। ১০ বছর পরম্পরায় ২০২১ সাল নির্ধারিত হলেও চলতি বছরের জুন মাসে তা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালে একটি জনগণনা হওয়ার কথা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের কারণে তা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনশুমারি হিসেবে। এরপর এবারই প্রথম নির্ধারিত সময়ের পরে জনশুমারি অনুষ্ঠিত হলো। এবারই প্রথম স্মার্ট টেকনোলজি ট্যাবের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই পদ্ধতিতে গণনাকারীর অতি উৎসাহী নীতি এবং টেকনোলজির অপব্যবহারের মাধ্যমে তথ্যের গুণগত মানে প্রভাব ফেলেছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।

এবারের শুমারিতে মোট জনসংখ্যার আকার পাওয়া গেল ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। এতদিন যা সরকারি-বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অংশীদার মনে করেছিল ১৭ কোটি বা সাড়ে ১৭ কোটি কিংবা ১৮ কোটি বা তারও বেশি। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, বিগত বছরে বলা হয়েছে- ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটিরও বেশি। অন্যদিকে অপ্রাপ্তবয়স্কের সংখ্যা যোগ করলে তা ১৮ কোটি ছাড়িয়ে যায়। ফলে সাধারণ মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। যেমন- তাহলে কি এই শুমারির তথ্য নির্ভরযোগ্য নয়, কিংবা গণনায় কোনো কিছু ভুলভ্রান্তি রয়েছে?

জনসংখ্যার আকার সম্পর্কে এসব পরিসংখ্যান ছিল সাধারণ মানুষের ধারণাপ্রসূত; কিন্তু পরিসংখ্যান বা বিজ্ঞানের ভাষায় প্রক্ষেপিত। অর্থাৎ ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর প্রাক্কলিত জন্মহার, মৃত্যুহার, অভিবাসন, আয়ুস্কাল ইত্যাদি অনুষঙ্গের সমীকরণ ধরে। আবার এই ১১ বছরের মধ্যে কিছু বছর পরপর এই উপাদানগুলোর বেশ কিছুর প্রক্ষেপণ হয়েছে জরিপের মাধ্যমে নমুনার ভিত্তিতে। জনমিতি বা পরিসংখ্যানের এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সারাবিশ্বের প্রতিটি দেশে একইভাবে ব্যবহার করা হয়। এই জটিল পদ্ধতির কারণে প্রক্ষেপিত এবং বাস্তব সংখ্যার মধ্যে একটা পার্থক্য থাকতে পারে, এটাও স্বাভাবিক। বৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্যও বটে।

২০১৫ সালে বিবিএস কর্তৃক প্রকাশিত ২০১১ থেকে ২০৬১ সালের জনসংখ্যা প্রক্ষেপণের যে মনোগ্রামটি প্রকাশিত হয়েছিল তা তৈরিতে আমার যুক্ত থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে ২০২১ সালে প্রক্ষেপিত জনসংখ্যার আকার ধরা হয়েছিল ১৭ কোটি ১৭ লাখের মতো, যা ২০২২ সালে কিছুটা বেশি হবে বলে ধরে নেওয়া হলেও জনশুমারিতে প্রাপ্ত জনসংখ্যার তুলনায় তা অনেকটা বেশি দেখা যাচ্ছে। সাত বছর আগের প্রক্ষেপণের সঙ্গে বাস্তবতার ব্যবধান হতে পারে এটাই স্বাভাবিক। আবার সেই মনোগ্রাম অনুযায়ী ২০২১ সালে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল, যা বাস্তবেও এই জনশুমারিতে ধরা পড়েছে।

সময়ের সঙ্গে জনসংখ্যা বাড়ার কারণে সব ধর্মের লোকের সংখ্যা এবারও বেড়েছে। ২০১১ সালের আদমশুমারির সঙ্গে তুলনা করলে মুসলমানদের তুলনায় হিন্দু ধর্মের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কিছুটা কম ধরা পড়েছে। ফলে ২০১১ সালের তুলনায় এবারের জনশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যার আনুপাতিক হার কমেছে। যেটি অসাবধানতার কারণে বিভিন্ন মিডিয়ায় ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, হিন্দু ধর্মের জনসংখ্যা কমেছে। এখানে বলা দরকার, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মতো ভারতেও মুসলমানদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিন্দুদের তুলনায় বেশি। এ ছাড়া আমাদের দেশে কিছুসংখ্যক হিন্দু দেশের বাইরে অভিবাসিত হলেও অনেকেই আবার অন্য ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে, এটাও সত্য। যতদূর জানা যায়, এই জনশুমারিটি ডি-ফ্যাক্টো পদ্ধতিতে হয়েছে, ফলে খানার কোনো ব্যক্তি প্রবাসে থাকলে তাঁকে গণনায় ধরা হয়নি; যেটি শুমারির পুরোপুরি নিয়ম মেনে হয়েছে। ফলে জনশুমারির প্রাপ্ত প্রাথমিক জনসংখ্যার সঙ্গে ১ কোটি প্রবাসী (আনুমানিক) যুক্ত হলেও দেশের মোট জনসংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে ১৭ কোটির মতো।

শুমারি থেকে প্রাপ্ত বাস্তব সংখ্যাকে পরিসংখ্যানের ভাষায় প্যারামিটার বলা হয়। এই প্যারামিটারগুলো সঠিকভাবে বের করা না গেলে তা সার্বিকভাবে উন্নয়নের পরিকল্পনার লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এর আগে ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল মার্চে, ২০০১ সালেরটি জানুয়ারিতে, আর ১৯৯১ সালেরটি হয়েছিল মার্চ মাসে। ফলে শীতকালের শেষে এবং বর্ষা আসার আগেই জনশুমারির জন্য প্রথাগত আদর্শ সময় বলে বিবেচনা করা হলেও এবার এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। গণনাকালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে গণনায় বাদ যাওয়া, অসম্পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ, ত্রুটিপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ বা ডুপ্লিকেট তথ্য সংযোজনের মতো ভুলভ্রান্তির আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। এবারের জনশুমারির ক্ষেত্রে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক বন্যা হওয়ায় তা তথ্যের গুণগত মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে বন্যাপরবর্তী আবার গণনার মাধ্যমে তথ্যের গুণগত মান বজায় রাখা কতখানি সম্ভব হয়েছে, দেখতে হবে। প্রতিটি খানায় সশরীরে গিয়ে প্রতিটি তথ্য সংগ্রহের কথা থাকলেও এবার জনশুমারির সময় সবক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। শহরের ক্ষেত্রে অনেক এলাকায় বিল্ডিংয়ের কেয়ারটেকারের কাছ থেকেই সব খানার সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। গ্রামের ক্ষেত্রেও অনেক সময় একই রকম পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। এভাবে তথ্য সংগ্রহ হলে প্রকৃত তথ্য নিবন্ধিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। পাড়া-মহল্লা, রাস্তায় গণনাকারীদের চেহারা দেখা গেলেও শতভাগ খানায় তাদের দেখা মেলেনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে শুমারির শেষ দিনের সন্ধ্যায় এক গণনাকারীকে পেয়ে ডেকে নিয়ে আমার খানার সব তথ্য দিয়েছি।

জনশুমারির প্রাথমিক ফল জানা গেলেও গণনা-পরবর্তী যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া এখনও বাকি রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় তথ্যের গুণগতমান সঠিকভাবে বজায় ছিল কিনা তা নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে নির্ধারণ করা হয় এবং প্রয়োজনে জনসংখ্যার আকার কিছুটা সংশোধনও করা হয়। ফলে চূড়ান্ত জনসংখ্যার আকার পেতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।

ড. মো. হাসিনুর রহমান খান: অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান, পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×