ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

খাদ্য নিরাপত্তা

চালের বাজারে অতিমুনাফা ও পুষ্টির দ্বন্দ্ব

চালের বাজারে অতিমুনাফা ও পুষ্টির দ্বন্দ্ব

হারাধন সরকার

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২২ | ১২:০০

বাংলাদেশে কৃষি ফসলের বৈচিত্র্যায়ণ ঘটছে। তারপরও ধানই আমাদের প্রধান ফসল। ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। গত ৫০ বছরে খাদ্যশস্য, বিশেষত ধানের আবিস্কৃত জাত, ফলন ও উৎপাদনের পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে। কৃষক ধানের জোগান দিচ্ছেন। তবে চালকলের মাধ্যমে সেই ধান চালে রূপান্তরিত হয়ে এক বা একাধিক হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে পৌঁছাচ্ছে। অটোরাইস মিলগুলোর মাধ্যমেই বেশিরভাগ চাল উৎপাদন হয় বিধায় তাদের উৎপাদন-আচরণ এখানে প্রধান বিবেচ্য। এটা অনস্বীকার্য যে, চাল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় ভোক্তার অধিকার ও স্বার্থ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। পাশাপাশি ধান গবেষকদের কর্মসাফল্য কদর্যভাবে অবমূল্যায়িত। এরূপ অবস্থায় কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন :বাজার থেকে সত্যিকার অর্থে আমরা কোন ধানের চাল ক্রয় করছি? আমরা কি যৌক্তিক মূল্যে যথাযথ পুষ্টিমানসম্পন্ন চাল পাচ্ছি? চালের পুষ্টিমান নিয়ন্ত্রণ ও বিপণনে কার্যকর সরকারি নীতি আছে কিনা এবং থাকলে তার কার্যকারিতা কতটুকুু? ধান গবেষকদের আবিস্কৃত ধান থেকে উৎপাদিত চালের বস্তার গায়ে সংশ্নিষ্ট ধানের নামগুলো স্পষ্ট ও সন্দেহমুক্তভাবে মুদ্রিত থাকে কি? বাজার পর্যবেক্ষণ, কেনাকাটা ও ভোগের অভিজ্ঞতা থেকে এসব প্রশ্নের অবতারণা।

উল্লিখিত প্রশ্নাবলির ওপর কয়েক বছর ধরেই সংক্ষিপ্তভাবে আলোকপাত করা হচ্ছে। তবে বাংলা ভাষায় বিশদ লেখার পরিমাণ কম। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় আইন, বিধি ও নীতি-রণনীতি-কাঠামো, ব্যবসায়িক নৈতিকতা ও মুক্তবাজার অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে চাল নিয়ে চালবাজির স্বরূপ ও কার্যকারণ বিশ্নেষণে ঘাটতি আছে। বর্তমান আলোচনায় মস্ত বড় একটা সুবিধার দিক হলো, সরকার তথা খাদ্য মন্ত্রণালয় খোলাখুলিভাবেই জানান দিচ্ছে চালের বাজারে কারসাজি আছে; ভোক্তাকে ঠকানো হচ্ছে; চাল পলিশকরণের নামে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পুষ্টি উপাদান সরিয়ে ফেলা হচ্ছে এবং নাজিরশাইল বা মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে অথচ সরকার এগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে না বা করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

শহরবাসী জনগণের প্রায় সবাইকে চাল ক্রয় করে ভোগ করতে হয়। সাধারণভাবে গ্রামবাসীর মধ্যে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিদের আংশিকভাবে চাল কিনতে হয়। মোটের ওপর সিংহভাগ ভোগকারীই চালের ক্রেতা এবং কেনা অধিকাংশ চালই অটোমিল বা বস্তাজাত। আমরা বাজার থেকে যে চাল খাচ্ছি, তা কি ধানের চাল? আমরা যদি বিক্রেতার কথা বা বেশি চাল কিনলে বস্তার গায়ে লেখা বিশ্বাস করি, তাহলে চালের নাম বা কোন ধানের চাল তা জানতে বা বলতে পারব। কিন্তু সেটা কি আসল নাম? পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাও সঠিক নাম জানেন না। শুধু মিলাররা বলতে পারবেন। তবে তাঁরা আসল নাম কারও কাছে প্রকাশ করেন না বা করবেনও না; বরং বস্তায় যা লেখা রয়েছে, তার প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলেন। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? প্রকৃত ধানের নাম ও বস্তার গায়ে লেখা নামে ফারাক আছে। কারণ আমরা অবগত যে মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাটারি ধান নেই বললেই চলে।

বাজারে অনেক ধরনের সিদ্ধ সরু চাল পাওয়া যায়। ভোক্তার মধ্যে একটা অংশ সরু চাল খোঁজে। এই সরু চাল আমরা পাচ্ছি 'জিরা নাজির/কাটারি নাজির' নামের বস্তায়। প্রশ্ন হলো, এগুলো কি সত্যিকার অর্থে সরু চাল? নিশ্চয়ই নয়। কারণ যে ধানের চাল ঘোষণা করা আছে, বাস্তবে সেই ধান যেহেতু নেই, তাহলে ব্রি উদ্ভাবিত জাত থেকে অপেক্ষাকৃত সরু চাল কীভাবে বাজারে আসবে? টেকনিক্যাল ভাষায়, মিলিং মাত্রা (সাধারণ কথায় চাল পলিশ করার মাত্রা) যত বেশি হবে, চাল তত সরু হবে। এভাবেই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইস্টিটিউট উদ্ভাবিত জাত অপেক্ষাও সরু চাল উৎপাদন ও বাজারজাত চলছে। মিলিং মাত্রা সর্বোচ্চ কতটা রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য, এটি সম্পর্কে কোনো নীতিভিত্তিক তথ্য পাওয়া যায় না। আবার বাস্তবে মিলিং মাত্রা কতটুকু ব্যবহূত হচ্ছে, সেরূপ কোনো জরিপ তথ্যও লভ্য নয়।


চাল উৎপাদকদের যুক্তি, ভোক্তা সরু চাল চায়। তাই তাঁরা সরু করছেন। কী কারণে তাঁরা সরু করছেন? অতিমুনাফার আকাঙ্ক্ষা, মুষ্টিমেয় ভোক্তার চাহিদা নয়। জনগণের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা থাকা দোষের নয়, তবে পুরোনো দিনের সরু চাল না পেলে খাবে না, তা নয়। পুষ্টির ব্যাপারে ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ১০৮টি জাত উদ্ভাবন করেছে। তবে সবক'টির আবাদ হচ্ছে না। আবিস্কৃত জাতগুলোর মধ্যে ব্রি ২৮, ২৯ খুবই জনপ্রিয়। এগুলোর চেয়েও অপেক্ষাকৃত সরু ও সুগন্ধিযুক্ত জাতও আছে। উল্লেখ্য, সারাদেশে আউশ মৌসুমে ৯৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ, আমন মৌসুমে ৮৭ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং বোরো মৌসুমে মোট ধানের ৯৯ দশমিক ৭২ শতাংশ আধুনিক জাতের ধান চাষ হয়। সব মৌসুমে গড় হার ৯৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। লোকাল জাতের ধান ৫ শতাংশের মতো চাষ হয়। কাজেই বাণিজ্যিক বা ব্যাপকভাবে পুরোনো জাতের সরু ধান বা অন্যান্য ধান চাষ হয় না।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক উদ্দেশ্যের মধ্যে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে 'নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ'। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য জনগণের প্রধান খাদ্য ভাতের একমাত্র কাঁচামাল চালে যথাযথ পুষ্টিমান বজায় রাখার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতি, তার কঠোর বাস্তবায়ন, ফলোআপ ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে কি? জাতীয় পুষ্টি নীতিতে তার সুনির্দিষ্ট প্রতিফলন লক্ষণীয় নয়। বিএসটিআই অন্যান্য পণ্যের গুণগত মান নিয়ে সংশ্নিষ্ট থাকলেও চালের ব্যাপারে তাদের সংশ্নিষ্টতা নেই। অনেক পুষ্টিযুক্ত খাবার আছে। সব মানুষ সব খেতে পারে না বা অনেকে খেতে সমর্থও নয় কিংবা অনেকে পুষ্টি সম্পর্কে সচেতন নয়। কিন্তু কমবেশি সবাই ঐতিহ্যগতভাবেই ভাত খায়। কাজেই ভাতের পুষ্টিমান সংরক্ষণ অপরিহার্য। কার্যকর নীতি ছাড়াও কঠোর আইন এবং পক্ষপাতহীন ও কঠোরভাবে তা বলবৎ করা অত্যাবশ্যক।

আমাদের গর্বের বিষয় হলো, বাংলাদেশের ধান বিজ্ঞানীরা পুষ্টিসমৃদ্ধ ও সুস্বাদু অনেক ধান আবিস্কার করেছেন। অথচ চালের বস্তার গায়ে কাল্পনিক নাম ব্যবহার করে একদিকে ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা, অন্যদিকে ধান আবিস্কারকদের অনন্য অবদানকে অসম্মান করা হচ্ছে। কীভাবে তাঁরা এসব করতে পারছেন আর সরকার কীভাবে তা মেনে নিচ্ছে, এটি সত্যিই অচিন্তনীয় ও রহস্যময়। অথচ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এফপিএমইউ বা খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের গবেষণা সারসংক্ষেপে (জুন ২০১৪) বলা হয়েছে, ভোক্তাকে বাজারে লভ্য বিভিন্ন চালের গুণগত মান সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত করতে হবে; চালের বস্তার গায়ে লেবেলিং বাধ্যতামূলক করা উচিত এবং চালের পুষ্টিমান সংক্রান্ত তথ্যও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য আইন- ২০১৩-এর ৩২(খ) ধারায় মোড়কীকরণে বা লেবেলে দ্রব্যের গুরুত্ব বাড়াতে কোনো মিথ্যাচার বা অপকৌশল কিংবা বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া যাবে না। উৎপাদক-ব্যবসায়ীরা সেই আইন তোয়াক্কা করেন না, যেহেতু আইন প্রয়োগে সরকারি কঠোরতা নেই।

ধান-চালের সাপ্লাই চেইনে কোনো রকম বিকৃতি ও কৃত্রিমতা কাম্য নয়; অন্তত জনগণের সস্তায় পুষ্টিপ্রাপ্তি বিবেচনায়। মুনাফাখোরি প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসায়িক নৈতিকতার অনুসরণ, বিএসটিআইয়ের মতো পৃথকভাবে চালের গুণগত মান নিরূপণ ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা, চাল উৎপাদন-বিপণন ইত্যাদি বিষয়ে স্বতন্ত্র কঠোর আইন, বিধি, নীতি ও রণনীতি প্রণয়ন অপরিহার্য। আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেগুলো প্রয়োগে সরকারকে নিরপেক্ষ, আপসহীন ও বজ্রকঠিন হতে হবে।

ড. হারাধন সরকার: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
phsmymen@gmail.com

আরও পড়ুন

×