'দুর্ঘটনা'র দায়

বিদেশি একটি স্কিন ব্যাংকের ছবি-সংগৃহীত
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২২ | ১২:০০
নির্বাচনী সহিংসতার জেরে আবারও একজন মায়ের কোল খালি হলো। এবার এ হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে ঠাকুরগাঁওয়ে। গত বুধবার ছিল জেলার রানীশংকৈল উপজেলার বাচোর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। শুক্রবার সমকালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সময় দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ লাগে। তা থামাতে কর্তব্যরত পুলিশ গুলি ছোড়ে। সেই গুলিতে নিহত হয় ভোটের ফলাফলের ঘোষণা দেখতে যাওয়া এক মায়ের কোলে থাকা শিশু সুরাইয়া। দুঃখজনকভাবে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রাণঘাতী সহিংসতা দেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা ডেমক্রেসিওয়াচের হিসাবে, ২০১৬ সালে ৮৯ জন এ ধরনের নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতায় মারা গিয়েছিলেন, আর নির্বাচনের দিন নিহত হয়েছিলেন আরও ৫৩ জন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০২১ সালে শুধু বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৬২৭টি ঘটনায় ১১৩ জন নিহত হন। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংশ্নিষ্ট আইনে সংশোধনী আনে। এতে একদিকে এসব নির্বাচনে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল ও এর প্রধান প্রতিপক্ষের মধ্যকার দীর্ঘদিনের সংঘাতমূলক রাজনীতির প্রভাব পড়ে, আরেকদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল তীব্র রূপ নেয়। আর পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এ উভয়ের প্রভাবে বেড়ে গেছে নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ার পরও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে হয়তো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেত যদি নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসন সব ধরনের নির্বাচনী সহিংসতা বন্ধে তৎপর থাকত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বাস্তবে তা দেখা যায় না। প্রশাসনের সর্বস্তরে দলীয়করণের যে দুঃখজনক রেওয়াজ কয়েক দশক ধরে আমরা দেখে আসছি, এ-সংক্রান্ত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে বর্তমান সরকারকে তা অব্যাহত রাখতে আমরা দেখেছি। এর সঙ্গে আছে দুর্নীতির বিস্তার। ফলে বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে, স্থানীয় প্রশাসন একেবারে শুরুতেই শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত প্রার্থীদের পক্ষ নিয়ে বসে থাকে। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার ভুলে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। আমাদের মনে আছে, বিশেষ করে বর্তমান কমিশনের দুই পূর্বসূরি রকিবউদ্দীন ও নূরুল হুদা কমিশনের সময়ে যখন একের পর এক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সহিংসতায় প্রাণহানি ঘটছিল এবং সংবাদমাধ্যমসহ সচেতন নাগরিকরা এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, তখন সংশ্নিষ্ট কমিশনের পক্ষ থেকে রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে এগুলোকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আরও দুর্ভাগ্যজনক হলো, এ পর্যন্ত একাধিকবার পূর্বসূরিদের ওই কথিত ঐতিহ্য থেকে সরে আসার অঙ্গীকার করেও বর্তমান নির্বাচন কমিশন ওই একই ধারায় হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে। শুক্রবার সমকালেরই আরেকটি প্রতিবেদন অনুসারে, ঠাকুরগাঁওয়ের আলোচ্য বেদনাদায়ক ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বৃহস্পতিবার বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা সিইসি বলেছেন, একটা হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনে এ রকম ঘটনা ঘটে থাকে। শুধু তা নয়, একই দিনে এক ইংরেজি দৈনিকের এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, সিইসি ওই নির্বাচনী সহিংসতায় শিশু খুনের ঘটনাকে 'দুর্ঘটনা' বলে উল্লেখ করেছেন। একটা দায়িত্বশীল জায়গায় বসে সিইসির এ রকম দায়িত্বহীন উক্তি শুধু সন্তান হারানো মা-বাবার কষ্টকে বাড়িয়ে দেবে না, তাঁরা যে এ ঘটনায় বিচার না পাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাকে আরও গভীর করে তোলে।
আমরা দেখেছি, কী এক অদ্ভুত কারণে বিশেষ করে নির্বাচনের সময়ে এবং শিক্ষাঙ্গনে সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় দেশে আজ পর্যন্ত যত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর একটারও বিচার হয়নি। এ ধরনের প্রাণঘাতী সহিংসতার পুনরাবৃত্তির অন্যতম কারণ এ বিচারহীনতার সংস্কৃতি তা জানার পরও কোনো সরকারই এসব ঘটনায় স্বজনহারাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেনি। তবে আমরা মনে করি, ঠাকুরগাঁওয়ের শিশু সুরাইয়া খুনের ঘটনায় যথাযথ তদন্তপূর্বক দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করে সংবিধানবিরোধী ওই নির্মম ধারার অবসান ঘটানো যায়। একই সঙ্গে এ ঘটনায় সহিংসতামুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নির্বাচন কমিশনও জেগে উঠতে পারে।