ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মতামত

মন্তব্য গন্তব্য ঠেকাতে পারে না

মন্তব্য গন্তব্য ঠেকাতে পারে না

ফেসবুকে পরিচয়ের পর ছয় মাস প্রেম, তারপর বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন নাটোরের এক কলেজছাত্র ও শিক্ষিকা

এহ্‌সান মাহমুদ

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২২ | ০৮:২৮ | আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২২ | ০৮:৩৮

সম্প্রতি দুটি ঘটনা প্রায় একই সময়ে জানা গেল। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা হলেও বিষয়ের দিক থেকে এক!

প্রথম ঘটনার দিকে তাকাই। 

'মানুষের মন্তব্য কখনও গন্তব্য ঠেকাতে পারে না'- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এমন মন্তব্যের ছড়াছড়ি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকেই তাঁদের প্রোফাইলে এমন মন্তব্য লিখছেন। সামাজিকভাবে পরিচিত এমন এক নারী তাঁর ফেসবুকে লিখেছেন : 'মন্তব্য কখনও গন্তব্য ঠেকাতে পারে না। আমার এখন ৪২ চলে। যাক এখনও তাইলে আশা আছে! ২২ বছরের কারা কারা আছো, আওয়াজ দাও।' সেই লেখার নিচে অসংখ্য কমেন্ট জমা হয়েছে। একজন মন্তব্য লিখেছেন : 'আপু আমার ২৬ চলে। কোনোভাবে ম্যানেজ করা যায় কিনা দেখেন।' বাঙালি রসিক। উপলক্ষ পেলে এমন মন্তব্য করতে তাদের জুড়ি নেই। আরেকজন লিখেছেন :'বছরের সেরা মোটিভেশন বক্তব্য হচ্ছে- মন্তব্য কখনও গন্তব্য ঠেকাতে পারে না।' 

এই ঘটনার নেপথ্যে যা সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয়ের পর ছয় মাস প্রেম, তারপর বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন নাটোরের এক কলেজছাত্র (২২) ও শিক্ষিকা (৪০)। বর্তমানে তাঁরা নাটোর শহরের একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছেন। গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর এম হক ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক খাইরুন নাহার। তাঁর প্রথমে বিয়ে হয়েছিল রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়। তবে পারিবারিক কলহে বেশি দিন টেকেনি সংসার। সেখানে তাঁর এক সন্তান রয়েছে। তারপর কেটে যায় অনেক দিন। এর মাঝে ফেসবুকে পরিচয় হয় কলেজছাত্র মামুনের সঙ্গে। তিনি নাটোরের এনএস সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ফেসবুকে পরিচয়ের পর তাঁরা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং সব শেষে বিয়ে করেন। বিয়ের পরে তাঁরা সামাজিক কারণে তা গোপন রেখেছিলেন। পরে ফেসবুকে দু'জনের ছবি প্রকাশ করে তাঁরা বিয়ের ঘোষণা দেন। মুহূর্তেই তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় সংবাদকর্মীদের দৌড়ঝাঁপ। এই সময়ে কলেজছাত্র মামুনের বক্তব্য- 'মানুষের মন্তব্য কখনও গন্তব্য ঠেকাতে পারে না। কে কী বলল, সেগুলো মাথায় না নিয়ে নিজেদের মতো সংসার গুছিয়ে জীবন শুরু করেছি।' খাইরুন নাহার বলেছেন, 'প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হওয়ার পর মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত মানসিক কষ্টে কাটত। একবার আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ঠিক সেই সময় ফেসবুকে পরিচয় হয় মামুনের সঙ্গে। মামুন আমার খারাপ সময় পাশে থেকে উৎসাহ দিয়েছে এবং নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখিয়েছে। সে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে আমাকে। আর সেই ভালোবাসা থেকেই দু'জনের সিদ্ধান্তে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই।' 

এবার দ্বিতীয় ঘটনায় আসি।

বাবার মৃত্যুর পর একাকিত্বের যন্ত্রণা বাড়তে থাকায় ফেসবুকে মায়ের জীবনসঙ্গী খুঁজে পেতে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন এক ছেলে। তিন দিনে পাত্র হিসেবে যোগাযোগ করেছেন প্রায় ১০০ জন। একটি ফেসবুক গ্রুপে মায়ের জন্য পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে ছেলে অপূর্ব লিখেছেন, 'বাবা মারা গেছে তাই আম্মুর জন্য পাত্র খুঁজছি। আম্মুর সাথে মানানসই পাত্র খুঁজছি। অবশ্যই ঢাকার আশেপাশে হলে ভালো। ব্যবসায়ী বা জবহোল্ডার; শিক্ষাগত যোগ্যতা কম হলেও সমস্যা নেই। নামাজি হতে হবে মাস্ট। মানে একদম সাদামাটা একজন, যে আম্মুর জীবনের বাকি চলার পথগুলোর সঙ্গী হবে। ৪২-৫০ বয়স হলে ভালো হয়।' পাত্রী হিসেবে মা ডলি আক্তারের বিবরণও দিয়েছেন অপূর্ব। ৪২ বছর বয়সী ডলি আক্তার পড়াশোনা করেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। উচ্চতা পাঁচ ফুটের বেশি। মায়ের জন্য পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার যুক্তি দেখিয়ে অপূর্ব আরও লিখেছেন, 'এমন কাউকে জীবনসঙ্গী হিসাবে প্রয়োজন, যার কাঁধে মাথা রেখে মনের কথাগুলো বলা যাবে। আমার মা আমার কাঁধে মাথা রেখেও অনেক কথা বলতে পারেন, কিন্তু সেটা তো আর জীবনসঙ্গীকে বলার মতো করে হবে না।'

ছেলে অপূর্বর পোস্টের নিচে ইতোমধ্যে অসংখ্য মন্তব্য জমা হয়েছে। কেউ কেউ লিখেছেন, পাত্র-পাত্রী চেয়ে বহু ধরনের বিজ্ঞপ্তি দেখলেও মায়ের জন্য পাত্র চাওয়ার এমন বিজ্ঞপ্তি তাঁরা আগে কখনও দেখেননি। মরিয়ম আক্তার প্রীতি নামে একজন লিখেছেন, 'সমাজ কী বলবে তা দেখার দরকার নেই। কজ আমাদের সন্তানদের যেমন নিজের জীবনের ডিসিশন নেওয়ার অধিকার আছে, ঠিক তেমনি মা-বাবারও আছে। অনেক পরিবারের মানুষ এইটা অ্যাকসেপ্ট করতে পারে না কিন্তু এইটা ভুল। জীবনে চলার পথে সঙ্গী লাগে।' নওহার তাসনীম নামের আরেকজন লিখেছেন, 'সবাই তো এ রকম হয় না। বিশেষ করে, মাকে বিয়ে দেওয়া রেয়ার। বাবাকে করানো জায়েজ এই সমাজে, বাট মাকে এই ছেলেটা এই বয়সেই বিয়ে করাতে যাচ্ছে, মানে এটা দেখা বা শোনা যায় না।'

এই দুটি ঘটনাতেই একটি বার্তা স্পষ্ট দেখা যায়। আর তা হচ্ছে- নিজের মতো কাজ করা। অর্থাৎ, জগৎ-সংসার-সমাজ যা-ই বলুক না কেন, নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া। সমাজের চোখ রাঙানি, নিষেধাজ্ঞা, বিশ্বাস ভেঙে দিয়ে নিজের মতো বাঁচতে চেষ্টা করা। বয়সের ব্যবধানে বিয়ের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। রূপকথার রহিম-রূপবানের বিয়ে থেকে শুরু করে অজস্র উদাহরণ এখান থেকেও দেওয়া যায়। আবার মায়ের বিয়ের জন্য পাত্র চাই বিজ্ঞাপন কেবল সিনেমার পর্দায় নয়, আমাদের সামনেও ঘটে চলেছে। 'মায়ের বিয়ে' সিনেমা দেখে যে দর্শক হাততালি দিয়েছে, দেখা যাচ্ছে সে দর্শকই মায়ের বিয়ের জন্য পাত্র চাই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া অপূর্ব নামের তরুণকে নিন্দা করছে।

প্রায়ই সংবাদপত্রের বরাতে আমরা জানতে পারি, পারিবারিক কলহের জেরে খুনের ঘটনা ঘটছে। আবার মানসিক টানাপোড়েন, একাকিত্বে ভুগে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন কেউ কেউ। এসব ঘটনার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একাকী মানুষ সবসময় হতাশায় ভোগে। জীবন নিয়ে তারা আশাবাদী হতে পারে না। তাদের কাছে শরতের আকাশ এবং আষাঢ়ের আকাশের বিশেষ তফাত থাকে না। ঝুম সন্ধ্যায় দুই কাপ চা হাতে পাশে দাঁড়িয়ে- 'এসো চা খাই' বলার মতো একজন মানুষ থাকা জরুরি। এজন্য যেটা সবচেয়ে প্রথম দরকার তা হলো, নিজের মুখোমুখি হওয়া। নিজেকে বলা, আমি নিজের জন্য বাঁচতে চাই। এর পরেই পরিবারের সদস্য, বন্ধু-স্বজনদের এগিয়ে আসতে হয়। পরিবারের বিষণ্ণ সদস্যটি কী করে হাসিখুশি হতে পারে, তার মনের খবর নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। নাটোরের কলেজছাত্র-শিক্ষিকার বিয়ে এবং কেরানীগঞ্জের মায়ের জন্য পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপন আমাদের সমাজবদলের কথাই ঘোষণা করেছে। এই বদলের সুরটা বুঝতে পারলে আমাদের সবারই মঙ্গল। 

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×