ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শ্রদ্ধাঞ্জলি

অমিত হাবিব :দ্য নিউজ এডিটর

অমিত হাবিব :দ্য নিউজ এডিটর

খায়রুল বাশার শামীম

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০২ আগস্ট ২০২২ | ১৩:২২

অফিসকক্ষে চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেটে টান। সামনে রিপোর্টার। অমিতদা, অমিত হাবিব, শুরু করলেন- 'বলেন'। রিপোর্টার বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর কথা শেষ হতেই অমিতদার প্রশ্নবাণ। কে, কী, কেন, কীভাবে, কোথায়- প্রতিবেদন কাঠামোর গৎবাঁধা প্রশ্ন ছাপিয়ে নেপথ্যের অনুসন্ধান। তাঁর সঙ্গে কয়েক মিনিটের কথায় রিপোর্টারের স্টোরি যেন জীবন্ত রূপ পেত। এর পর অমিতদার মুখ থেকে সবচেয়ে বেশি শোনা বাক্য- 'যান, এবার লিখে ফেলুন; দ্রুত দেবেন।'
অমিতদা তখন ভোরের কাগজের নিউজ এডিটর। রিপোর্টার কী লিখছেন, তা নিউজ এডিটরকে জানাতে হয়। রিপোর্টাররা নিয়ম করে তাঁর কাছে জানান দিয়ে পরামর্শ নিয়ে লিখতে বসেন। রিপোর্ট ছাপা হবে, কিন্তু লেখায় ফাঁক থাকবে, এটা অমিতদা হতে দিতেন না। কীভাবে রিপোর্টারদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ভালো কাজটা আদায় করে নিতে হয়, তা তিনি জানতেন। পরবর্তী সময়ে আমরা যারা বিভিন্ন সংবাদপত্রের নিউজরুম চালিয়েছি, তা তাঁর শেখানো পথেই।

১৯৯৮ সাল। অমিতদার নেতৃত্বে ভোরের কাগজে এক ঝাঁক পেশাদার সাংবাদিক, সবাই তরুণ। সাংবাদিক মহলে 'নিউজ এডিটর' মানেই অমিত হাবিব। আমি সাব-এডিটর। কাজ করছি, শিখছি। তখন রিপোর্টাররা লিখতেন নিউজপ্রিন্ট কাগজে। কলম হাতে নিউজরুমের কর্মীরা সেগুলো এডিট করতেন। আমিও চেষ্টা করি। কিন্তু এডিটিং তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। রিপোর্টারের কপি দেখতে নিজেও তুখোড় না হলে কীভাবে হবে? সকাল সকাল গিয়ে অমিতদার এডিট করা কপি খুঁজে বের করতাম- কীভাবে এডিট করলেন, কী ফেলে দিলেন, কী যোগ করলেন, ইন্ট্রো কী, কী হেডিংয়ে ছাড়লেন কপি। মুগ্ধ হই। নিজেকে গড়ি। অন্যদের গড়ে ওঠা দেখি। আমার এডিট করা কপি অমিতদাকে দেখাই। অমিতদার কলমে কখনও কখনও তছনছ কপি। আমার কপি কাটাছেঁড়া না হলে আনন্দে চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। তার মানে, আমি পেরেছি। আমাকে দিয়ে হবে, হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এই উপসংহারে পৌঁছেছি- যে সাংবাদিকতায় অমিতদা খুশি, সেটিই স্ট্যান্ডার্ড।
অমিতদা নিউজরুমেই জীবন কাটিয়ে দিলেন। আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ দিয়ে যে সাংবাদিকতার শুরু। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে মিডিয়া হাউসগুলো চলে গেলেও অমিত হাবিব তাঁর নিজের মতো করে গড়ে তোলা সাংবাদিকতার পরিবেশ নষ্ট হতে দেননি। কাজ চলছে। গল্প, আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া একাকার। বাইরের কেউ সে সময় নিউজরুমে ঢুকলে তাঁর মুখ থেকে একটা প্রশ্নই বের হতো- 'এখানে হচ্ছেটা কী?' কিন্তু পরদিন বাজারে যে পত্রিকা, তার মধ্যে অমিত হাবিবের কাগজই সেরা। আর হবেই বা না কেন!

সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা জগতের তাবৎ বিষয় থাকত তাঁর আড্ডা, কাজ কিংবা অবসরে। বলতেন, 'সব বিষয়ে গভীর জ্ঞান না থাকলে আর যাই হোক, সাংবাদিক হওয়া যায় না।' কম জানা-বোঝার মানুষ তাঁর কাছে ভিড়ত না। অমিতদার খুব প্রিয় একটা শব্দ 'দুর্দান্ত'। কথায় কাজে তিনি 'দুর্দান্ত' খুঁজতেন। দিন শেষে পত্রিকায় এর ছাপ থাকত স্পষ্ট।

অমিতদার হাত দিয়ে বেশ কয়েকটা নতুন কাগজের যাত্রা হয়েছে। নতুন পত্রিকার অনেক চ্যালেঞ্জ। প্রথমত, অচেনা মালিকপক্ষ। দ্বিতীয়ত, সাংবাদিকতার পরিসরই দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তার মোকাবিলা; টিম গোছানো; বাজার দখল করে রাখা; অন্য পত্রিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতা। অমিতদা যেন নতুন চ্যালেঞ্জ উপভোগ করতেন। চেনা লোকগুলোকে ঠিকই জড়ো করে ফেলতেন। আর প্রতিবার নতুন কাগজে অবশ্যই নতুনত্ব থাকত। পাঠক সহজেই নিত তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাকে। কালের কণ্ঠ এবং সর্বশেষ দেশ রূপান্তরের সাফল্য তাঁর হাতেই।

প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যৎ কী? সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎই বা কী? গত কয়েক বছরে এই বিতর্কে সাংবাদিকরা কত মত, কত তত্ত্ব যে দিয়েছেন, তার শেষ নেই। অমিতদা বলতেন, সব আমাদের হাতে। আমরা চাইলে বাঁচবে, না চাইলে মরবে।
অমিতদার শেষ দুই কর্মস্থলে তিনি উপদেষ্টা সম্পাদক এবং সম্পাদক। তাঁকে দেখেছি বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেই সম্পাদকের খোলস ছেড়ে নিউজরুমের সর্দার হয়ে গেছেন। ওই যে, তিনি তো আসলে নিউজম্যান, অন্য শব্দে নিউজ এডিটর। তা-ই করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। পত্রিকারও তাঁর কাছে দাবি থাকত- তিনি 'নিউজ' ঘিরেই তাঁর সর্বোচ্চটা দিন। তা-ই দিয়ে গেছেন। আরেকটি জায়গায় তাঁর অতুলনীয় দক্ষতা ছিল। সেটা নিউজের শিরোনাম। তাঁর কর্মী হিসেবে ঠেকে গেলেই বলতাম- 'অমিতদা, শিরোনামটা ঠিক আসছে না। বলতেন, আমাকে দিয়ে আরেকটা সিগারেট খাওয়াবেন, তাই তো? সিগারেট খেয়ে এসে যে শিরোনামটা দিতেন, তার তুলনা হয় না। যেসব কাগজে তিনি কাজ করেছেন, সেগুলোতে তাঁর দেওয়া শিরোনাম সংকলন করলে তা সাংবাদিকতার মাইলফলক হয়ে থাকতে পারে।

'সাংবাদিকতাকে মেরে ফেলছি আমরা। সাংবাদিকতা নেই দেশে। একটা মানুষ টাকা দিয়ে পত্রিকা কেনে। কী দিই আমরা?'- এভাবেই বলতেন অমিতদা। সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ করা আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। সঙ্গে এটাও বলতেন, চেষ্টা থাকলে সব আমলেই সাংবাদিকতা করা যায়।

অমিতদার নেতৃত্বের আরেকটা বড় গুণ ছিল চাপ সামাল দেওয়া। যত চাপ, সব কাঁধে তুলে নিতেন। আমরা যাঁরা নিচে কাজ করেছি, কখনও চাপ বুঝতাম না।

পত্রিকা-নিউজরুম বাদ দিলে অমিতদার অন্য পছন্দের তালিকাটাও ছোট। এর মধ্যে একটা বাঙালিয়ানা খাবার। রান্নায় ঝোঁক ছিল খুব। মাছ ছিল খুব প্রিয়। ইলিশ, নদীর রুই-কাতলা আর হাওর-বিলের মাছ। মাছ ধরার গল্প শুনলে বলতেন, এর পর গেলে বলবেন; যাব। কিন্তু যেতেন না, হয়তো সময় পেতেন না। ঢাকায় খুব ভালো রেস্তোরাঁ হয়েছে একটা- শুনে আগ্রহ দেখাতেন। কিন্তু অফিস থেকে বের হওয়া যেন তাঁর ধাতে নেই। দেশ-বিদেশে নতুন কোথাও বেড়িয়ে এসে গল্প করলেই বলতেন; যাব। পাসপোর্টটা রিনিউ করাতে হবে। ব্যস, ওই পর্যন্তই।

অমিতদা, এবার তো আপনি ঠিকই গেলেন। অচেনা, নতুন মুলুকে। কাউকে না বলে; একা। যেখান থেকে কেউ কখনও ফেরেনি, ফেরে না।

খায়রুল বাশার শামীম :বার্তা সম্পাদক, সমকাল

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×