ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

শিক্ষা

শেষ পর্যন্ত কোচিং থাকলই

শেষ পর্যন্ত কোচিং থাকলই

মামুনুর রশীদ

প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০

শিক্ষানীতির খসড়ায় কোচিং থেকেই যাচ্ছে; তবে অদ্ভুত একটি বিষয় সেখানে যুক্ত হয়েছে। শিক্ষকরা নিজের স্কুলের ছাত্রদের কোচিং করাতে পারবেন না। অন্য স্কুলের ছাত্রদের ক্ষেত্রে কোনো বাধা-নিষেধ নেই। বিজ্ঞজন এ ব্যবস্থার তদারকিতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি এই দাঁড়াল- কোচিং থেকেই যাচ্ছে, বরং তার একটা আইনগত ভিত্তি তৈরি হলো। কোচিংয়ের থেকে সহনশীলতা এবং প্রশ্রয় সরকারের দিক থেকে কেন যে তৈরি হলো, তা বোঝা সত্যিই দুরূহ। গত ৩০-৩৫ বছর ধরে কোচিং করার জন্য শিক্ষানুরাগীরা বারবার বলে এসেছেন। শিক্ষায় বাণিজ্যের আশঙ্কার সূচনা এ কোচিং থেকেই।
ঢাকা ওয়াসার শহরের মানুষদের সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার কথা। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে সরাসরি ওয়াটার সাপ্লাই দিয়ে পানি পান করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে ওয়াসা সুপেয় পানির জন্য বোতলজাত পানির ব্যবস্থা করেছে। তার মানে, প্রথমেই বলে দিচ্ছে- এই পানি পান করার জন্য নয়। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন এবং বেসরকারি স্কুলগুলোকে এমপিওভুক্ত করে সেখানকার শিক্ষকদের সরকারিভাবে একটা জীবিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপর সরকার নিজেই স্বীকার করছে- স্কুল-কলেজের শিক্ষাদানের ক্ষমতা অপ্রতুল।
কোচিং মানে শুধু স্কুল-কলেজের শিক্ষা নয়; ক্যাডেট কলেজ, মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি, প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষা- সর্বত্র তার শাখা-প্রশাখা প্রলম্বিত হয়েছে। আসলে স্কুল-কলেজে যাওয়ার আগে বা পরে শিক্ষার্থীদের একটা বড় সময় এই কোচিং ব্যবস্থার ভেতর রয়েছে। মোট কথা এই দাঁড়ায়, বেসরকারিভাবে একটি সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। এ দুই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে একটি শিশু, কিশোর, তরুণ শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। যার ফলে একটা সৃজনহীন, মেধাহীন শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এই কষ্টকর ব্যবস্থাটিতে ভালো শিক্ষার্থীর জন্ম হতে পারে না- তার প্রমাণ সর্বত্র। বিদেশ থেকে ধার করা চিবিয়ে পাঁচনকালে শিক্ষা নম্বর ও পরীক্ষাসর্বস্ব হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা মূল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষ কোনো অবস্থাতেই আর শিক্ষাকেন্দ্র থাকছে না। এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বিভাগে যোগ্য ছাত্র পাওয়া যায়নি। অথচ গোল্ডেন জিপিএ ৫-এর ছড়াছড়ি। মন্ত্রী-আমলারা কি একটু ইতিহাসের দিকে তাকাবেন?
পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তরের দশকের দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? সেই সময় কোচিং বাণিজ্যের রমরমা অবস্থাটা শুরু হয়নি। শুধু ফাইনাল পরীক্ষাগুলোর আগে স্কুলের শিক্ষকরাই একটু বাড়তি লেখাপড়া করাতেন; যার জন্য কোথাও বিনামূল্যে এবং কোথাও সামান্য কিছু অর্থ দিতে হতো। সেই সময়ে যাঁরা শিক্ষিত হয়েছেন, তাঁরাই শিক্ষকতা এবং আমলাতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে আজীবন অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
সেদিন এক সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা হলো। জানালেন, তিনি একটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন; সেখানে ছাত্রসংখ্যা ৩২ হাজার। অকপটে স্বীকার করলেন- আমরা শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহী না; আগ্রহী পরীক্ষার ব্যাপারে। কারণ এর মাধ্যমে প্রচুর ফি আসে। কলেজের অর্থনীতিটা বেশ সবল হয়। তারপর কোচিং সেন্টারগুলোর রমরমা ব্যবসাও হয়। বাকিটা শুধু নম্বর। এমনি বাংলাদেশে অনেক কলেজ আছে, যেখানে ছাত্রসংখ্যা ৩২ হাজারের ওপরে। বিশেষ করে বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বাণিজ্যটা আরও রমরমা। এমন একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, প্রকৃত শিক্ষা কোনো ব্যাপারই নয়। মূল ব্যাপার কলেজ ফি সংগ্রহ এবং কোচিংয়ের মাধ্যমে যতটা লেখাপড়া হয়। লেখাপড়ার মূল বিষয়টা দাঁড়িয়ে যায় মুখস্থ বিদ্যা এবং মানহীন কোচিং চর্চায়।
গত ২৫-৩০ বছর ধরে যাঁরা সরকারি চাকরি পেয়েছেন এবং সরকারের উচ্চ পদে আসীন, তাঁরাও ছিলেন কোচিং এবং মুখস্থনির্ভর। শিক্ষায় যে গভীর অসুখগুলো এখন দেখা যাচ্ছে তা সম্পূর্ণ এই প্রবল বাণিজ্যিকীকরণের কারণে। শিক্ষা যে শুধু অক্ষরজ্ঞান বা অঙ্কের কিছু নিয়ম শেখানো বা তোতা পাখির মতো মুখস্থ বিদ্যা নয়; একজন সত্যিকার মানুষ গড়ে ওঠার বিষয়- নীতিনির্ধারকরা তা কখনোই বুঝতে চান না। শিক্ষা যে একটা সংস্কৃতি এবং মানুষকে জীবন-জগৎ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়; তা একেবারেই উপেক্ষিত।
নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি কলেজে বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়ে থাকে। লাখ লাখ বেকার এখানে অর্থের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা করে। স্কুলের দপ্তরিও মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে চাকরিতে বহাল হন। শিক্ষার ক্ষেত্রে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতির দায়ে সর্বদাই অভিযুক্ত হয়ে থাকে। এরা প্রশ্ন ফাঁস, ভুয়া সার্টিফিকেট এবং নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। এসবের জন্য দরজা খুলে দেয় কোচিং বাণিজ্য। মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন- কোচিং খারাপ কিছু নয়। পক্ষান্তরে তিনি বলতে চাচ্ছেন, কোচিং চলবেই। মন্ত্রী কি ঢাকা শহর এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন ছোট-বড় শহরের অলিগলি-রাজপথের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন? সেখানে পোস্টার, ফেস্টুন, দেয়াল লিখনের মাধ্যমে অভিভাবকদের কী পরিমাণে আকর্ষণ করার প্রতিযোগিতা চলছে! কোনো কোনো শহরে আবাসিক ব্যবস্থা করে কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে যায় না। বছর শেষে কোনো প্রতিষ্ঠানে ফির টাকা জমা দেয়। শিক্ষামন্ত্রী কি পুরো ব্যাপারটাকেই আইনসিদ্ধ করে তুলছেন না?
পাশাপাশি রয়েছে মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা। সেদিকে নজরদারিটা একেবারেই ক্ষীণ। অনুমোদন পেয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠান দিনের পর দিন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকহীন সরকারি টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা এই বাণিজ্যের অংশ হিসেবে দৃষ্টি এড়িয়ে যান। মাঝেমধ্যে পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী তদন্ত হয়। তদন্তকে ভিন্ন পথে নেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। তাই যাঁরা বাণিজ্যটি সঠিকভাবে করতে পারেন না, তাঁরা ধরা পড়েন। এই শিক্ষার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি; তা প্রতিরোধে সরকার তেমন কোনো ব্যবস্থা এখনও করেনি। করলেও অতি দক্ষ শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এসব বিষয়ে সামাল দেওয়ায় জুড়ি নেই।
সরকার আগের চেয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে লগ্নি বাড়িয়েছে। কিন্তু তাতেও শিক্ষকদের মন পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁদের মুখ্য আয়ের জায়গাটা থাকছে কোচিং। এসব কারণে প্রকৃত শিক্ষা না থাকা এবং ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ থাবায় প্রকৃত শিক্ষা সুদূর পরাভূত। যার ফলাফল শিক্ষক হত্যা, শিক্ষক লাঞ্ছনা; সেই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে লুণ্ঠন। এই লুণ্ঠনকারীরা অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসেনি। তারা এ দেশেরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির কিছু দুর্নীতিপরায়ণ শিক্ষক এবং বাণিজ্যে উদ্বুদ্ধ পথভ্রষ্ট ছাত্ররা মিলে একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মাদ্রাসার নারী শিক্ষক এবং তাঁর ছাত্রীরা ধর্মের শান্তির বাণী না ছড়িয়ে ঘরে ঘরে ধর্মের বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছেন এবং সুযোগ পেলেই মৌলবাদকে উস্কে দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওয়াজ-মাহফিলের ভ্রান্ত প্রচারণা।
একটি মননশীল, সুবিচারের সমাজ গড়তে হলে সেখানে প্রয়োজন যথার্থ শিক্ষা, বিজ্ঞানমনস্কতা, সংস্কৃতি এবং জ্ঞানের চর্চা। কোচিং সেন্টারগুলোয় মুখস্থ বিদ্যাকে উস্কে দেওয়া হয়। সেখানে জ্ঞানচর্চার কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষকরা ঠিকাদার, কালোবাজারি ব্যবসায়ীর মতো আচরণ করতে করতে এক সময় সর্বক্ষেত্রে অসাধু হয়ে পড়েন। এ তো গেল একদিকের চিত্র। অন্যদিকে শিক্ষকদের মধ্যে একটা অংশ আছে; যাঁরা কোচিং করাতে চান না; শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাকে গুরুত্ব দেন এবং স্কুল-কলেজে সংস্টৃ্কতিচর্চার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা একেবারেই কোণঠাসা। প্রথমত, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে তাঁরা একঘরে। স্কুল-কলেজের ক্ষমতাবান ম্যানেজিং কমিটির সদস্য এবং শিক্ষকদের কাছে তাঁরা শত্রু। দুর্নীতিপরায়ণ শিক্ষকরা ওইসব আদর্শ শিক্ষককে ছাত্রদের কাছেও শত্রুভাবাপন্ন করে তোলেন। তাই শিক্ষককে লাঞ্ছনা করা, গলায় জুতার মালা পরানো, এমনকি হত্যা করাও তার কাছে অপরাধ মনে হচ্ছে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই সৎ শিক্ষকদের আশ্রয় দেওয়া। রাষ্ট্র এখন তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত। উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ বাহিনী, র‌্যাবসহ সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার লোকও রয়েছেন। এলাকার সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরাও আছেন। স্থানীয় সরকারের লোক এবং আইনপ্রণেতারা তাঁদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের বাইরে সবসময় অবস্থান করেন। ভোটের রাজনীতি, দেন-দরবার, ঠিকাদারি ও তরুণদের বিভ্রান্ত করার কাজে অধিকাংশ সময় নিয়োজিত থাকেন। তাঁরা বোঝেন না, সব জায়গায় কালো হাত দেওয়া ঠিক নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এসব বিষয়কে অপরাজনীতির বাইরে রাখা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলো ভোট ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে উৎসাহী নয়। তাদের সন্তান-সন্ততিও একটা সুস্থ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বড় হোক- এটাও তাদের কামনা হওয়া উচিত।
মামুনুর রশীদ :নাট্যব্যক্তিত্ব

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×