ঢাকা শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

ক্ষণজন্মা বীর মুক্তিযোদ্ধা 'রেণু'

ক্ষণজন্মা বীর মুক্তিযোদ্ধা 'রেণু'

আরমা দত্ত

প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২২ | ১৩:০১ | আপডেট: ০৭ আগস্ট ২০২২ | ১৩:০৮

সাধারণও যে কী অসাধারণ হতে পারে তার বিশেষ দৃষ্টান্ত সেই ধীরস্থির, স্নিগ্ধ, মেধাবী, বুদ্ধিমতী, সাহসী, দৃঢ়চেতা সেই অপূর্ব মানুষটি- যিনি বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের পাতায় শিলালিপিতে স্বর্ণাক্ষর দিয়ে রচিত ও প্রতিষ্ঠিত, যিনি আপন আলোয় আলোকিত আলোকবর্তিকার মতো। তিনি আর কেউ নন, তিনি সেই টুঙ্গীপাড়ার অসাধারণ ক্ষণজন্মা 'রেণু', যার অপর নাম, 'বঙ্গমাতা, বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব'। একাধারে দু'জন রাষ্ট্রনায়ককে সৃষ্টি করার জন্যই তাঁর এই পৃথীবিতে আগমন ও প্রস্থান। সেই দু'জন রাষ্ট্রনায়ক হলেন- বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং দেশবরেণ্য নেত্রী, বাংলাদেশের গর্ব, আগুনপাখি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ছোটবেলা থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে পরিবেশ ও পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছ মুজিব ঠিক সেই একই পরিবেশে বড় হয়েছেন, একই পরিবারে এবং একই পরিমণ্ডলে। স্বাভাবিকভাবেই 'বঙ্গবন্ধুর' আদর্শ ও রাজনীতি তার সহজাত মানসিকতা, সাহস ও আত্মবিশ্বাসীসত্তা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। সেই কিশোরী বয়স থেকেই সব ক্ষেত্রে স্বামী, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সমর্থন করার মধ্যে তাঁর প্রবণতা গভীরভাবে লক্ষ্য করা যায়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে তিনি প্রশ্নহীনভাবে সমর্থন দিয়েছেন, মনোবল ও সাহস জুগিয়েছেন, অপরিসীম প্রেরণা জুগিয়েছেন। এর সবই তিনি করে গেছেন একান্ত নিভৃতচারিণী হিসেবে ছায়ার মতো সঙ্গে থেকে এবং জীবনসঙ্গিনী হয়ে।

১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় এবং দুর্ভিক্ষের সময় তাঁর স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, বিভিন্নভাবে মানুষের সেবা করেছেন, তাঁর সঙ্গে একই রকম মনোভাব নিয়ে সার্বক্ষণিক সমর্থন দিয়ে গেছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, এমনকি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের প্রচারণা ও সার্বিক কর্মকাণ্ডে অপরিসীম সহযোগিতায় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে একান্তভাবে যুক্ত থাকতে দেখা যায় এবং ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গঠন করতে রাস্তায় নেমে লিফলেট বিতরণ করেছেন বঙ্গমাতা। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর জাতীয় নির্বাচন, ১৯৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনে সব রকম সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করে গেছেন নীরবে-নিভৃতে।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝোলানোর সব আয়োজন সম্পন্ন করলে ১৯৬৯ সালের ২১ জানুয়ারি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে আনতে সক্ষম হয় এবং রেসকোর্স ময়দানে এক ছাত্র-গণসংবর্ধনায় তিনি 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত হন। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের দীর্ঘ ১৪ বছর 'বঙ্গবন্ধু'কে কারাগারেই কাটাতে হয়েছে। দিনের পর দিন বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব শত সংকট মোকাবিলা করে সংসার সামলে ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করেছেন, তাঁদের পড়াশোনা করিয়েছেন। কোনোদিন স্বামীর প্রতি এতটুকু অভিযোগ করা তো দূরের কথা, সবসময় আপসহীন থেকে তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্যের পানে এগিয়ে যেতে নিরন্তর উৎসাহ ও সাহস জুগিয়ে গেছেন, এক যোদ্ধা ও সাহসিকার মতো। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের আগে দলীয় নেতাকর্মী ও বিভিন্ন পক্ষের নানামুখী মানুষের প্রস্তাব ও পরামর্শে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া না দেওয়া নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গমাতা বলেছিলেন, 'কারও পরামর্শ না শুনতে, নিজে যা সঠিক মনে করবেন, তাই বলতে পরামর্শ দিয়েছিলেন যাতে করে সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।' বঙ্গবন্ধু তাই করেছিলেন। এমনই ধীশক্তিসম্পন্ন তীক্ষষ্ট বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

বঙ্গমাতার স্মরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর ছিল এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও অসাধারণ সাহসী ছিলেন। আন্দোলন চলাকালীন প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় সাক্ষাৎকারের সময় বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ নিয়ে আসতেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সেই নির্দেশ জানাতেন এবং সংগঠনকে তিনি সংগঠিত করে রেখেছিলেন, এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মতো। বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনে বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে তাঁর আত্মজীবনী রচনা করার জন্য উৎসাহ ও প্রেরণা প্রদান করেন। তারই ফলস্বরূপ আমরা আজ পেয়েছি একটি অসাধারণ দলিল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জেলে বসে লেখা 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী'।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ বাঁচিয়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন অনেক বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল খাটিয়ে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে এ সংগঠনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করার কাজে তাঁর অবদান অপরিসীম। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ বাঁচিয়ে সংগঠনকে সংগঠিত করছেন, ছাত্রদের নির্দেশ দিয়েছেন এবং সব প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছেন।

বঙ্গমাতা ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালীন গৃহবন্দি থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন ও অতি সাহসিকতার সঙ্গে এবং তাঁর সন্তানদের সিংহীর মতো আগলে রেখে রক্ষা করেন। তিনি একজন বিশাল মাপের 'সাহসী আপসহীন নারী মুক্তিযোদ্ধা'।

বাঙালির অধিকার আদায় ছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে প্রধানমন্ত্রিত্ব বা ক্ষমতার কোনো আকর্ষণ ছিল না। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব সেই আদর্শে নিজেকে ও নিজের সন্তানদের আদর্শবান ও যোগ্য মানুষ হিসেবে তাদের গড়ে তোলেন। সহধর্মিণী হিসেবে নয়, রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে আজীবন প্রিয়তম স্বামী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছায়াসঙ্গী ছিলেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অনুপ্রেরণাদায়িনী হয়ে সর্বদা ছায়ার মতো পাশে ছিলেন।

নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালের কালরাত্রে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয় ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাতে। যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ তাঁদের তিন পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও পারভিন রোজীসহ পরিবারের সব সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে কয়েকজন বিপথগামী সামরিক সৈনিক। তাঁদের পবিত্র রক্তের ধারায় স্নাত হয়ে আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সেই বাড়িটি। যেই বাড়িতে ২৩ মার্চ ১৯৭১ 'বঙ্গবন্ধু' বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং ২৪ মার্চ ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এই হত্যাকে কি আমরা কখনও মেনে নিতে পারব? কখনই না। এই জঘন্য বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড একেবারেই ক্ষমাহীন।

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ক্ষণজন্মা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ও আদর্শকে আঁকড়ে ধরে উজ্জীবিত ও ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য অসমাপ্ত সোনার বাংলার কর্মকাণ্ডকে সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশকে দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেখে গেছেন দুই অসাধারণ বিদুষী কন্যাদের- যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছার আদর্শে ও চেতনায় স্নাত রেখে গেছেন বাংলাদেশের জন্য, তাঁদের দুই সুযোগ্য কন্যাদের, যারা হলেন বাংলাদেশের গর্ব, অসাধারণ সাহসিকা, সংগ্রামী, শেখ রেহানা এবং দেশবরেণ্য নেত্রী, আগুনপাখি, শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, যিনি দুর্বার গতিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের সড়ক ধরে, বুকে পিতা ও মাতার রক্ত ধারণ করে, ভেতরের তীব্র যন্ত্রণাকে শক্তিরূপে পরিণত করে একটি সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব যেমন আলোকবর্তিকা, তেমনি আমাদের স্বাধীনতা ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর অবদান অনন্য অবিস্মরণীয়। তেমনি তিনি তৈরি করে রেখে গেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা, দেশরত্ন গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। যিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার অসমাপ্ত কর্মকাণ্ডগুলো সমাপ্ত করে বাংলাদেশকে আরও উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় অদম্য গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর বুকে। এ এক বিরল দৃষ্টান্ত, কারণ তিনি তো তাঁদের আশীর্বাদপুষ্ট সন্তান।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অবদানের কথা তত বেশি উদ্ভাসিত হবে। তাঁরা দু'জন দু'জনের সম্পূরক এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ এক রূপকথার গল্পের মতো। হৃদয়ের ভেতরে গভীর ব্যথা লাগে যখন মনে হয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, ঠিক একটি প্রস্ম্ফুটিত ফুল ফুটে চারদিকে সুবাসিত করে, সেই 'রেণু' রক্তাক্ত হয়ে, মাটিতে ঝরে পরে। মানুষের চরিত্রের সঙ্গে প্রকৃতির যে এত মিল তার দৃষ্টান্ত খুবই কম দেখা যায়, যা প্রমাণ করে গেলেন নিজের জীবন দিয়ে। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব জন্মেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য এবং একই সঙ্গে তাঁর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে 'সহমরণ' হয়। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। আমি প্রথমেই লিখেছিলাম বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতার জীবন কাহিনি সব গল্প ও উপন্যাসকেও হার মানায়।

বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের প্রতি পাতায় বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার নাম চিরভাস্বর হয়ে আছে ও আবহমানকাল পর্যন্ত থাকবে সেই অপূর্ব সুবাস। সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহীয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা নারী, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের শুভ জন্মদিনে জানাই আমাদের সবার গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভালোবাসা। 'রেণু', তুমি অবিনশ্বর।

জয়তু বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা রেণু।

আরমা দত্ত: সংসদ সদস্য

আরও পড়ুন

×