ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

আইন-আদালত

ফৌজদারি কার্যবিধি সংক্রান্ত রায়টি বাস্তবায়ন হোক

ফৌজদারি কার্যবিধি সংক্রান্ত রায়টি বাস্তবায়ন হোক

মাবরুক মোহাম্মদ

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকদের যন্ত্রণা দেওয়া; নিষ্ঠুর, অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া বা কারও সঙ্গে কোনো ধরনের নির্দয় আচরণ করা যায় না। সংবিধান প্রদত্ত এসব বিধান ও অধিকার লঙ্ঘন করে প্রায়ই আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নাগরিকদের নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগ পাই। সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপক ব্যবহার ও তার সমালোচনার মধ্যে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার অপব্যবহার অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় যে কোনো নাগরিককে শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গ্রেপ্তার করা যায়। এই ধারায় আটকদের হয়রানি, নির্যাতন এমনকি কখনও কখনও মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়।
১৯৯৮ সালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২৩ জুলাই মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। প্রায় একই সময়ে সীমা চৌধুরী নামে এক তরুণী চট্টগ্রামের রাউজানে পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা যান এবং অরুণ চৌধুরী নামে এক যুবক রাজধানীর মালিবাগ থানায় পুলিশ হেফাজতে মারা যান। পুলিশ হেফাজতে রুবেলের মৃত্যুর পর বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের নেতৃত্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে ১১ দফা সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, অরুণ চক্রবর্তীর স্ত্রীসহ কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তি। রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্টের ঘোষিত রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের জন্য সাত দফা সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে আদালত আইন সংশোধনের আগেই ১৫ দফা নির্দেশনা মেনে চলতে আদেশ দেন।
এই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে একটি আপিল করে। প্রায় ১৩ বছর পর ২০১৬ সালের ২৪ মে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এই দুই ধারায় যাতে কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়, সে জন্য আপিল বিভাগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচারকদের জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা দেন। রায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যে ৮টি নির্দেশনা মেনে চলার আদেশ দেওয়া হয়- গ্রেপ্তারের পর একটি মেমোরেন্ডাম তৈরি করে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর নেওয়া; গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির পরিবারকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে অবহিত করা; গ্রেপ্তারের কারণ কেস ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা; বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-এর ৩ ধারার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে ৫৪ ধারায় আটক না করা; গ্রেপ্তারের সময় নিজের পরিচয় প্রকাশ করা; গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন থাকলে আঘাতের কারণ ও বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা ও মেডিকেল সার্টিফিকেট গ্রহণ করা; কোনো ব্যক্তিকে তার বাসা বা ব্যবসায়িক স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা না হলে থানায় আনার ১২ ঘণ্টার মধ্যে তার স্বজনদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো; গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি স্বজন বা আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ চাইলে তা প্রদান করা। এ ছাড়াও আপিল বিভাগ অভিযোগ আমলে নেওয়ার বিচারকদের প্রতি ৯টি নির্দেশনা দেন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারার বিষয়ে উচ্চ আদালতের বিস্তারিত নির্দেশনা সত্ত্বেও এ দুই ধারার অধীনে নাগরিকদের হেনস্তার অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। ২০২০ সালের করোনাকালে কুয়েত, বাহরাইন ও কাতার থেকে ফেরত ২১৯ জন প্রবাসীকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন শেষে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেপ্তারের কারণ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করায় তাঁদের বেশ কয়েকজন হাইকোর্টে মামলা করেন। এই মামলায় ৫ নভেম্বর ২০২০ তুরাগ থানার এসআই মো. শফিউল্লাহ হাইকোর্টে হাজির হয়ে তার প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারকৃতরা বিদেশে গিয়ে অপরাধ সংঘটনের পাঁচ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। তবে তিনি ৫৪ ধারা সংক্রান্ত আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী, মামলাটির কোনো কেস ডায়েরি উপস্থাপন করতে পারেননি। সিএমএম আদালতের বিচারকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মামলা সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা কেস ডায়েরি উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়ায় মামলাটি খারিজ করা হয়েছে। ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের বিষয়ে আপিল বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় শুনানিতে হাইকোর্ট উষ্ফ্মা প্রকাশ করেন বলে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়। আদালত বলেন, রায়টি বাস্তবায়নে নজর দেওয়া উচিত।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা নিয়ে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের রায় বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের জুডিশিয়াল অ্যাক্টিভিজমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ বিষয়ে আমরা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের বিভিন্ন সময়ের বিচারপতিদের ঐকমত্য ও রায় বাস্তবায়নে সক্রিয়ভাবে সচেষ্ট থাকতে দেখেছি; এটাও প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলাদেশের মানবাধিকার আন্দোলনে রায়টিকে বড় অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, রায়ের নির্দেশনার আলোকে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা দুটি আজও সংশোধন করা হয়নি। আমাদের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উচ্চ আদালতের রায় আইনের মর্যাদা লাভ করে। তাই আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন ও রায়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য তেমন কোনো সুফল বয়ে আনার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
মাবরুক মোহাম্মদ: মানবাধিকারকর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্র

আরও পড়ুন

×