ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

রাজনীতি

এ ছাত্রলীগ লইয়া আ'লীগ কী করিবে?

এ ছাত্রলীগ লইয়া আ'লীগ কী করিবে?

সাইফুর রহমান তপন

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মনে প্রশ্ন জেগেছিল- 'এ জীবন লইয়া কী করিব?' অবস্থাদৃষ্টে একই ভাবনার উদয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনে হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মাস কয়েক আগেও সরকারের যে মন্ত্রীরা ইউরোপ-আমেরিকার বিদ্যমান উচ্চহারের মূল্যস্ম্ফীতির উদাহরণ টেনে বলতেন, বাংলাদেশের জনগণ ওদের তুলনায় সুখে আছে; সেই মন্ত্রীরাই গত কিছুদিন ধরে এমনকি হাতজোড় করে জনগণকে আর দু-এক মাস কষ্ট করার অনুরোধ করছেন। জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধির চাপে পিষ্ট জনগণকে সান্ত্বনা দিতে খোদ প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, জ্বালানির দাম দ্রুত কমানোর পথ খোঁজা হচ্ছে। মন্ত্রীদের 'বিনয়ী' হওয়ার পেছনে প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থানও কাজ করতে পারে বৈকি। তবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সে পথ মাড়াতে রাজি নন বলে মনে হচ্ছে।
সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখা গেছে, ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে আরেক শিক্ষার্থীকে তাঁর কক্ষে ডেকে তিন ঘণ্টা আটকে রেখে রড, স্টাম্প দিয়ে মারধর করেন। ওই শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকাও আদায় করেন এবং বলেন, ৫ ঘণ্টার মধ্যে আরও ৬ হাজার টাকা নিয়ে আসতে হবে। না হলে তাঁকে হল থেকে বের করে দেওয়া হবে। ভাস্কর সাহা এমনও বলেন, আক্রান্ত শিক্ষার্থী যদি এসব কথা বাইরে বলেন, তাহলে তাঁর পরিণতি হবে বহুল আলোচিত বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মতো। আবরারের কথা আমাদের মনে আছে; ২০১৯ সালে ফেসবুক পোস্টে সরকারের সমালোচনা করায় বুয়েট ছাত্রলীগের কিছু নেতা তাঁকে দীর্ঘ সময় ধরে নির্যাতন করে মেরেই ফেলেছিল।
শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই নেতা নন; প্রায় একই সময়ে ছাত্রলীগের ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শাখার নেত্রী তামান্না জেসমিন রিভার 'কীর্তি' সম্পর্কেও সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে। সেখানকার রাজিয়া হলের এক কক্ষের দখল নিয়ে সাধারণ ছাত্রীদের রিভা বলেছেন, তাঁর কথা না শুনলে এক পায়ে পাড়া দিয়ে আরেক পা ছিঁড়ে ফেলবেন তিনি। অবশ্য এসব কথার 'অডিও' ফাঁস হওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে ভুল স্বীকার করেছেন রিভা। 'দায়িত্বশীল জায়গায় থেকে অসংযত ভাষা' প্রয়োগের 'অপরাধ' স্বীকার করে তিনি সংগঠনের কাছেও 'ক্ষমাপ্রার্থী' হয়েছেন। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটিও তাঁর এ ক্ষমা প্রার্থনা মঞ্জুর করে। কিন্তু বুধবারের খবর হলো, মঙ্গলবার রাতে রিভা দুই ছাত্রীকে ডেকে এনে তাঁদের ওপর সাড়ে ৬ ঘণ্টা নির্যাতন চালান আগের দিনের অডিও অন্য এক নেত্রী ফাঁস করেছেন মর্মে স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য। বোঝা যায়, ওই ক্ষমা প্রার্থনা ছিল রিভার ছল মাত্র।
একজন দু'জন নন; সারাদেশে এ রকম অনেক রিভা ও ভাস্কর ছড়িয়ে আছেন। একটু খোঁজ নিলে ছাত্রলীগের প্রায় প্রতিটি ইউনিটেই এদের দেখা মিলবে। ইডেন কলেজেই রিভার অনেক পূর্বসূরির কথা আমরা জানি, যাঁরা হলকক্ষ দখল করে সেখানে রীতিমতো টর্চার সেল বসিয়েছিলেন! কেউ কেউ তো ছাত্রীদের কাছে আসন ভাড়া দিতেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল।
হলের আসনগুলো বোধ হয় এখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে নেই। রাবির বিভিন্ন হলে বৈধ শিক্ষার্থীদের নিজের আসনে থাকা কতটা কঠিন; এ নিয়ে মাঝেমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে খবর হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে তথাকথিত গেস্টরুম কালচার; বিশেষ করে ছাত্র হলগুলোতে নতুন কোনো ছাত্র উঠলেই তাঁকে হলের গেস্টরুমে ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে গিয়ে নানা 'আদব-কায়দা' শিখতে হয়। এর সামান্য ব্যত্যয় ঘটলে ভোগ করতে হয় নানা ধরনের শাস্তি। ২০১৬ সালে ফরিদপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা মেধাবী ছাত্র হাফিজ এ ধরনের শাস্তির শিকার হয়ে মারা যান। অভিযোগ উঠেছিল, কী এক কারণে সেখানকার ছাত্রলীগ নেতারা আরও কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে হাফিজকেও শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করেন। এতে তাঁর প্রাণঘাতী নিউমোনিয়া বেধে যায়।
ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় সারাদেশ থেকেই মাঝেমধ্যে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, অপহরণ ইত্যাদি ফৌজদারি অপরাধে জড়িত হওয়ার অভিযোগ আসে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেওয়া হয় না। আসলে ব্যবস্থা নেবে যারা, বিশেষ করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা; তারা নিজেরাই তো নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। টাকার বিনিময়ে শুধু কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ নয়; বিভিন্ন জেলা-উপজেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া এখন 'ওপেন সিক্রেট'। গত এক যুগে যাঁরাই ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ ধারণ করেছেন; তাঁদের সবার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ কম-বেশি আছে। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় কমিটি সীমিত হয়ে পড়ে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে। অর্থাৎ তাঁদের বাইরে কেন্দ্রীয় কমিটির আর কারও কোনো মূল্য তো থাকেই না; কর্মও থাকে না। এমনকি ভাগাভাগির ভিত্তিতে কমিটি হয় বলে সভাপতি চেনেন না সাধারণ সম্পাদকের কোটায় কেন্দ্রীয় পদ পাওয়া লোকদের। সাধারণ সম্পাদক চেনেন না সভাপতির অনুসারীদের। কীভাবে সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গোছানো যায়, সবাই শুধু সেই পথ চেনেন। প্রধানমন্ত্রী জনগণকে নিয়ে কী ভাবছেন; নিজের ধান্দায় ব্যস্ত ছাত্রলীগ নেতাদের পক্ষে কি তা অনুসরণ করা সম্ভব?
আমরা জানি, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার আগে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল মূলত আওয়ামী লীগের জন্মের পথকে যতটা সম্ভব মসৃণ করার জন্য। ইতিহাস সাক্ষী- ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে সবচেয়ে জোরদার ভূমিকা রেখেছিল ছাত্রলীগ; যে আন্দোলন বাঙালি মুসলমানের পাকিস্তান মোহে একটু হলেও চিড় ধরিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার আগে তো বটেই, স্বাধীনতার পরেও বিশেষ করে ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগকে এগিয়ে নেওয়ার কাজই নিষ্ঠার সঙ্গে করেছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এ থেকে জাতিও উপকৃত হয়েছে। কিন্তু সংগঠনটির হাল যা দাঁড়িয়েছে বর্তমানে; তা দিয়ে আওয়ামী লীগের কী লাভ হবে; জাতিরই বা কী লাভ হবে?
সাইফুর রহমান তপন: সাংবাদিক এবং সাবেক ছাত্রনেতা

আরও পড়ুন

×