ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

ঘোড়ার আগে গাড়ি

ঘোড়ার আগে গাড়ি

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২২ | ২১:১৪

নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫০ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে; তা অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার নামান্তর বলে মনে হয়েছে আমাদের কাছে। ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিবের বরাত দিয়ে বুধবার সমকালের এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় ইসি এ সিদ্ধান্ত নেয়।

আমাদের বক্তব্য হলো, নির্বাচন নিয়ে জনমনে বিশেষ করে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে, তা আগে দূর করতে হবে। তারপর নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। তা না করে ইসি উল্টো পথে হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে। কেউ যদি মনে করেন, ইসির এ সিদ্ধান্ত শাসক দলের অনুসরণে গৃহীত- তাঁকে নিশ্চয় দোষ দেওয়া যাবে না। কারণ ইসির সংলাপে আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন আগামী নির্বাচনে নিশ্চিতভাবে ইভিএম চায়নি। তা ছাড়া গত ফেব্রুয়ারিতে চার কমিশনারসহ শপথ নেওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার-সিইসি বলেছিলেন, তাঁরা চান আগামী জাতীয় নির্বাচনে সব দল অংশগ্রহণ করুক।

সেই হিসেবে সবার আস্থা অর্জনই হবে তাঁদের প্রথম প্রয়াস। আমরা মনে করি, মঙ্গলবারের ইভিএম-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত সিইসির এ কথার সঙ্গে সাংঘর্ষিক শুধু নয়; এর পর বিরোধী দলগুলোর কাছে, বিশেষ করে বিএনপি ও তার মিত্রদের কাছে, যারা আগামী নির্বাচনের অন্যতম প্রধান অংশীজন; ইসির পৌঁছানোর আর কোনো সুযোগই থাকবে না। বিএনপি ইভিএমকে স্রেফ একটা 'কারচুপির যন্ত্র' বলে মনে করে। ইতোমধ্যে দলটি ঘোষণা দিয়েছে, ইভিএম নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো আলোচনায় তারা রাজি নয়। এমনকি যে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ বহু বছর ধরে মহাজোট চর্চা করেছে; আওয়ামী লীগের কল্যাণেই যে দলটি এখন সংসদের বিরোধী দলের আসনে অধিষ্ঠিত; তারাও বলছে, ১৫০ আসনে ইভিএম চালুর পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হলো 'ভোট কারচুপি'।

ইভিএম ভোট গ্রহণ ও গণনার একটা উন্নত প্রযুক্তি। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাঁরা চান নির্বাচন কমিশন এ যন্ত্রটি চালু করুক। আবার অনেকে আছেন যাঁরা বলেন, পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি যুক্ত করলে যন্ত্রটি প্রায় সর্বাংশে ত্রুটিমুক্ত হবে। কারণ তখন বোঝা যাবে ভোটার কোন মার্কায় ভোট দিয়েছেন, যা ব্যবহার করে প্রয়োজনে ভোট পুনর্গণনাও করা যাবে। একই সঙ্গে এ বাস্তবতাও মনে রাখতে হবে, বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইভিএম একেবারেই অরক্ষিত। ভোটকেন্দ্র দখল হলে তো কথাই নেই; কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ একটু ঢিলেমি দিলেই ইভিএমে জাল ভোটের পাহাড় বানানো সম্ভব। প্রথমত কন্ট্রোল ইউনিটে ভোটারের আঙুলের ছাপ মিলে যাওয়ার পর ব্যালট ইউনিটে যে কেউ টিপ দিতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, অনেকের আঙুলের ছাপ মেলে না বলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা একটা নির্দিষ্ট শতাংশের ভোটারকে আঙুলের ছাপ মেলানো ছাড়াই ভোট দেওয়ার অনুমতি দিতে পারেন। এসব কারণে ২০১০ সালে তৎকালীন ইসি যখন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রথম ইভিএম ব্যবহার করে, তখনই এর বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর কাছ থেকে আপত্তি এসেছিল। পরবর্তী সময়ে এ বিতর্ক আর থামেনি বরং বেড়েছে। যে কারণে গত দুটি জাতীয় নির্বাচন দূরে থাক; এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সব স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও এ যন্ত্রের ব্যবহার হয়নি।

গত দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক অঙ্গনে তো বটেই; জনপরিসরেও যে বিতর্ক আছে; আগামী জাতীয় নির্বাচনেও তা অব্যাহত থাকুক; এমনটা গণতন্ত্র-সচেতন কোনো মানুষের কাছে কাম্য হতে পারে না। সিইসি একাধিকবার বলেছেন, তাঁরা তাঁদের দুই পূর্বসূরির লিগ্যাসি থেকে বেরিয়ে আসতে চান। শুধু তাই নয়; তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, আগামী নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো হবে না। তার মানে, আগামী নির্বাচনকে তাঁরা শুধু অংশগ্রহণমূলক নয়; অবাধ ও সুষ্ঠুও করতে চান। তা করতে হলে আমরা মনে করি, বিরোধী দলগুলোর মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দ্রুত ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং যে কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

আরও পড়ুন

×