রাষ্ট্রব্যবস্থা
কারা এই বৈষম্য ঘোচাবে

আবু সাঈদ খান
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২২ | ০৩:০৩
স ংবিধানে আছে- বাংলাদেশের মালিক জনগণ। প্রকৃতপক্ষে জনগণ হচ্ছে প্রাকৃতজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- 'জীবন মরণে।/ ওরা চিরকাল/ টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল,/ ওরা মাঠে মাঠে/ বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে।/ ওরা কাজ করে/ নগরে প্রান্তরে।'
এই প্রাকৃতজন এখন আর শুধু দাঁড় টানা আর ফসল বোনার কাজে নিয়োজিত নেই। যে প্রান্তিক নারীর কাজ ছিল ঘরে ফসল তোলা; এখন তাঁদের কারও কারও পায়ে ফুটবল, হাতে ব্যাট। সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া, সানজিদা, সালমা, রুমানা, জাহানারা- একঝাঁক সোনাঝরা নাম। সম্প্রতি এই সোনার মেয়েরা সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরেছেন।
দেশবাসী এই বিজয়-আনন্দে মেতেছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর বিজয়ী বীররা যখন কাঠমান্ডু থেকে ঢাকায় হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর পৌঁছলেন, তখন সমবেত হাজার হাজার নারী-পুরুষ জয়োল্লাসে ফেটে পড়লেন। সেখান থেকে তাঁরা যখন ছাদ খোলা বাসে রাজধানী প্রদক্ষিণ করছিলেন, তখন আবালবৃদ্ধবনিতা রাজপথের দু'পাশে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে, ফুল ছিটিয়ে, পতাকা দুলিয়ে অভিনন্দন জানালেন। কিন্তু তাঁরা যখন মতিঝিলে বাফুফে কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হলেন, তখন মনে হলো, তাঁদের বিজয় যেন ছিনতাই হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে সামনের সারির চেয়ারগুলো মন্ত্রী-আমলা-বাফুফে কর্মকর্তাদের দখলে চলে গেল। মেয়েরা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সাংবাদিক-ক্যামেরাম্যানদের চিৎকারেও কর্তাদের হুঁশ হলো না। তাঁরা বুঝতে চাইলেন না- তৃণমূল থেকে উঠে আসা মেয়েরাই সেদিনের নায়ক। নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মুখে কী অদম্য মনোবলে তাঁরা নিজেদের গড়েছেন! নিভৃত পল্লির কুটিরে ছিল তাঁদের বসবাস। অনেকেরই দু'বেলা খাবার জুটত না। তার ওপর ছিল সমাজপতিদের চোখরাঙানি- মেয়ে হয়ে কেন ফুটবল খেলবে? হাফপ্যান্ট-শার্ট পরবে; দেশ-বিদেশ ঘুরবে! বাফুফের আচরণও ছিল বৈষম্যমূলক। ছেলে ফুটবলারদের তুলনায় তাঁদের সুবিধাদি ছিল কম। সেই সুবিধাবঞ্চিতরাই ইতিহাস গড়ল। হিমালয়ের শীর্ষে বাংলাদেশের পতাকা উড়াল।
টেলিভিশনের পর্দায় যখন বিজয়ী মেয়েদের আসন ছিনতাই হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখছিলাম, মনে হলো, এভাবেই একাত্তরের গৌরবগাথা বেহাত হয়ে গেছে। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের ধারেকাছে ছিলেন না, তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়েছেন। চাকরি-পদোন্নতি লাভ করেছেন। একাত্তরে যাদের বয়স ছিল ৭-৮ বছর, তারাও মুক্তিযোদ্ধা। অথচ অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। তাঁরা তালিকাভুক্ত হতে পারেননি বলে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। তাতে তৃণমূলের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। মুক্তিযুদ্ধে ব্যক্তির অবস্থান নিয়ে যত গবেষণা ও চর্চা হয়েছে; শ্রেণির অবস্থান নিয়ে তত গবেষণা বা চর্চা হয়নি। তাই একবাক্যে বলা যাবে না- কতভাগ নিম্নবিত্ত-বিত্তহীন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তবে তাঁরাই সর্বোচ্চসংখ্যক।
এটি সত্য যে, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নব আঙ্গিকে যে মুক্তিসংগ্রামের সূচনা হয়; মধ্যবিত্তরা তাঁর নেতৃত্বে ছিলেন। একাত্তরের নেতৃত্বও ছিল মধ্যবিত্তের হাতে। সেই সময়ে রাজনৈতিক ও ছাত্রকর্মী, সাবেক সেনাসদস্য প্রত্যন্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন গড়ে তোলেন। কিষান, যুবক, ছাত্র ও শ্রমিক- সামাজিক অবস্থানে যাঁদের সিংহভাগই নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন; ব্যাপকভাবে তাঁরাই অস্ত্র হাতে লড়েছেন। জনগণ তাঁদের আশ্রয় দিয়েছেন, খাবার জুগিয়েছেন। নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। সেই বিবেচনায় মুষ্টিমেয় শান্তি কমিটি-আলবদর-রাজাকার ছাড়া সেই সময়ের পুরো জনগোষ্ঠীই মুক্তিযোদ্ধা।
স্বাধীনতাউত্তর তৃণমূলের মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণের ভূমিকা চলে যায় আড়ালে। খুব কমই তাঁদের কথা উচ্চারিত হয়। এ কথা উচ্চারিত হয় না- জনগণই মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়ক। আর জনগণের সিংহভাগই কিষান-মজুর-প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। এ জনগোষ্ঠী এখনও দেশের মানুষের মুখের অন্ন জুগিয়ে চলেছে। দেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পেছনে সরকার, গবেষক, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো নিজ নিজ কৃতিত্ব সগৌরবে প্রচার করছে। তাদের ভূমিকা অস্বীকার করছি না। কিন্তু কৃষকেরও যে বড় অবদান আছে- তা প্রচার করার কেউ নেই। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের পর কৃষক কৃষির আধুনিকীকরণের দিকে ঝুঁকেছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবে তা পেরে উঠছিলেন না। পর্যাপ্ত ব্যাংক সহযোগিতা মিলছিল না। আশির দশকে কৃষক সন্তানরা মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেন। তাঁদের পাঠানো অর্থেই এলাকায় ব্যাপকভাবে শ্যালো মেশিন-ডিপ টিউবওয়েল বসানো হয়। এভাবেই কৃষিতে নীরব বিপ্লব ঘটে যায়।
কৃষক এখানেই থেমে নেই। যে শ্যালো মেশিন সেচে ব্যবহার করা হচ্ছে; তারই ইঞ্জিন চাল-আটার কলে ব্যবহূত হচ্ছে। একই ইঞ্জিন নৌকায় লাগালে তা দ্রুত চলছে। ভ্যানে লাগিয়ে নছিমন-করিমন তৈরি হচ্ছে। এভাবেই গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূত সাফল্য এনেছেন কৃষক। ট্রলার-নছিমন-করিমনের কারিগরি ত্রুটি আছে বলে যে সমালোচনা রয়েছে, সেটি ঠিক। তবে এই কারিগরি ক্রটি কীভাবে দূর করা যায়; সেটি এখন ভাববার বিষয়।
গ্রামীণ যুবকদের বিদেশযাত্রা এখনও অব্যাহত। তাঁরাই রেমিট্যান্সের অন্যতম জোগানদাতা। শহর ও গ্রামের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের শিক্ষিত সন্তানরা ইউরোপ-আমেরিকায় গিয়ে স্থায়ী নিবাস গড়ছেন। অনেক মেধাবী তরুণ জনগণের অর্থে পড়াশোনা করেছেন; উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। পড়াশোনা শেষে তাঁদের দেশে ফেরার কথা থাকলেও ফিরছেন না। তাঁরা বিদেশে স্থায়ী হচ্ছেন। উপরতলার প্রবাসীদের সিংহভাগই দেশে অর্থ পাঠাচ্ছে না। বরং অনেকেই পৈতৃক বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি বেচে বিদেশে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের বড় উৎস তৈরি পোশাকশিল্প। এ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ প্রাপ্য। তবে সেখানেও রয়েছে হতদরিদ্র মেয়েদের সুনিপুণ হাতের পরশ। যাঁরা একদা গ্রাম ছেড়ে শহরে গৃহকর্মীর কাজ নিয়েছিলেন, তাঁদেরই অনেকে এখন গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করছেন। ইউরোপ-আমেরিকার নারী-পুরুষের জন্য পোশাক তৈরি করছেন।
এটি আজ স্বীকৃত যে, গ্রামের কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক ও গার্মেন্ট কর্মীরাই অর্থনীতির প্রাণশক্তি। তাঁদের ঘাম, ত্যাগে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। তৃণমূলের মানুষ প্রমাণ করছেন- তাঁরাও পারেন। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সাবিনা-সালমারা বাংলাদেশের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে পারেন। প্রশ্ন হলো- এসব কর্মঠ, দেশপ্রেমিক শ্রমজীবীকে রাষ্ট্র কি যোগ্য মর্যাদা দিচ্ছে?
কৃষক অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার শিকার। সার-বীজ পেতে নানা হয়রানি। যখন ফসল ওঠে, তখন সরকারি ক্রয়কেন্দ্র ফসল কেনে না। যখন ধান, গম মহাজন-আড়তদারের কাছে চলে যায়, তখন সরকার তা কিনতে শুরু করে। কৃষকদের পকেট মারতে মহাজন-ফড়িয়া দুর্নীতিবাজ কর্মচারীরা একাট্টা। শ্রমিকদের অবস্থা নাজুক। তাঁরা করোনাউত্তর পরিস্থিতিতে সন্তানদের স্কুল-কলেজে পড়াতে পারছেন না। মেয়েরা হচ্ছে বাল্যবিয়ের শিকার। প্রবাসী শ্রমিকরাই কি ভালো আছেন? বিমানবন্দর থেকে শুরু হয় হয়রানি। দেশে রেখে যাওয়া তাঁদের পরিবার থাকে নিরাপত্তা-ঝুঁকিতে।
সংবিধানে আছে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য রাষ্ট্র বিশেষ সুযোগ দেবে। রাষ্ট্র কার্যত সেই সুযোগ দিচ্ছে না, বরং পেছনে ঠেলছে। আজ ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও গরিব হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন দ্রুত ধনী হওয়া দেশের মডেল। এর মানে দ্রুত গরিব হওয়ার দেশও।
করোনার আগে দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল ২০ শতাংশ মানুষ। গবেষকরা বলছেন, আরও ২০ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। বলা বাহুল্য, মহা-কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ।
একাত্তরে আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? এ জন্যই কি ৩০ লাখ নর-নারী জীবন দিয়েছেন? কে বা কারা এই বৈষম্য ঘোচাবে? যে মানুষ একাত্তরে হাতুড়ি-কাস্তে ছেড়ে রাইফেল উঁচিয়ে ধরেছিলেন; পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন; তাঁদের পাশে কি কেউ নেই দাঁড়ানোর? যে মধ্যবিত্ত মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারা আজ ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার সিঁড়ি; ধনিক-বণিকদের স্বার্থের পাহারাদার। আর বামপন্থিরা নির্বিকার।
৩০ লাখ শহীদের রক্তভেজা দেশে এই অনিয়ম-বৈষম্য কতকাল চলতে থাকবে? পাকিস্তানের ঘনঘোর রাজনৈতিক অমানিশার মধ্যে ছাত্রসমাজ নতুন পথ দেখিয়েছিল। সেই পথেই ২৩ বছর লড়াই চলেছে; একাত্তরে স্বাধীনতা এসেছে। এখনও আসেনি মুক্তি; প্রতিষ্ঠিত হয়নি সামাজিক-অর্থনৈতিক সাম্য, যা বাংলাদেশের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে রাজনীতির ভেতর ও বাইরের তারুণ্যদীপ্ত বিবেকবান মানুষ কি রুখে দাঁড়াতে পারেন না?
আবু সাঈদ খান: উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল
- বিষয় :
- রাষ্ট্রব্যবস্থা
- আবু সাঈদ খান